ভারতে হিন্দুত্ববাদ বর্তমানে কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং এক বহুমাত্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দেশটির গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও ধর্মীয় সম্প্রীতিকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই মতাদর্শের উত্থান কেবল বর্তমান সময়ের ঘটনা নয়, এর শিকড় উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মধ্যেই নিহিত। তবে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার এক শক্তিশালী ধারা বজায় ছিল। সেই ধারা ভেঙে হিন্দুত্ববাদ ক্রমশ সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।
হিন্দুত্ববাদকে বোঝার জন্য প্রথমেই এর মৌলিক ধারণাটি ধরতে হবে। হিন্দুত্ব কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণের প্রকল্প। এই প্রকল্পে হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনর্গঠন করার স্বপ্ন দেখানো হয়। এর ফলে ভারতীয় সমাজের বহুমাত্রিকতা, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈনসহ বহু সম্প্রদায় একসঙ্গে বসবাস করে এসেছে, তা সংকীর্ণ পরিচয়ের ছাঁচে ফেলা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করে ভারত হিন্দুদের ভূমি এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেবল সহনশীলতার কারণে এখানে বসবাসের অধিকার পায়। এই ধারণা ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রভাব দেখা যাচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানরা ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে অবদান রেখে আসছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পরিচয়ই একধরনের বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) কিংবা জাতীয় নাগরিক তালিকা (NRC)-এর মতো উদ্যোগ সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া, গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে লিঞ্চিং, মসজিদ ভাঙা বা নামাজ পড়া নিয়ে হয়রানি, ধর্মীয় প্রতীক নিয়ে আক্রমণ—সবই মুসলমানদেরকে এক প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ প্রচারাভিযানকে কেন্দ্র করে সারা ভারতে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, তা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এই সাম্প্রদায়িক প্রকৃতিরই প্রকাশ।
হিন্দুত্ববাদ কেবল সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াচ্ছে না, বরং ভারতের ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থান করছে। ভারতবর্ষ হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল। দিল্লির কুতুব মিনার, আগ্রার তাজমহল কিংবা বেনারসের ঘাট—সবই এই বহুত্বের সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ এই সাংস্কৃতিক বহুত্বকেই অস্বীকার করে একক হিন্দু পরিচয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। এর ফলে ভারতের অতীত ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা চলছে। অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম শাসনামলের স্থাপত্য বা সাহিত্যকে ‘বিদেশি’ বলে আখ্যায়িত করে উপেক্ষা বা বিকৃত করার চেষ্টা হচ্ছে।
রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদ এখন সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই মতাদর্শকে ভিত্তি করে ক্ষমতায় এসেছে এবং টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে তা ধরে রেখেছে। নির্বাচনী প্রচারণায় ‘আই লাভ মহাদেব’ বা ‘জয় শ্রীরাম’-এর মতো স্লোগান ব্যবহার করে একদিকে হিন্দু ভোটারদের সংগঠিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মুসলমানদেরকে প্রান্তিক করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে। উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ কিংবা কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলোতে এই রাজনীতি সবচেয়ে তীব্রভাবে দেখা যায়। সাম্প্রতিক বিক্ষোভে দেখা গেছে কিভাবে একটি ধর্মীয় পোস্টার নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো একদিকে বিভাজনের রাজনীতি জিইয়ে রাখছে, অন্যদিকে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে।
হিন্দুত্ববাদের উত্থান ভারতের গণতন্ত্রকেও নতুন সংকটে ফেলেছে। গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো ভিন্নমত ও ভিন্ন পরিচয়কে স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ ভিন্নমতকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে। যারা এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদেরকে প্রায়ই রাষ্ট্রবিরোধী বলে অভিযুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আন্দোলন, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশ—সব ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ববাদী প্রভাবের কারণে একধরনের ভয়-ভীতি কাজ করছে। গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ সরকারপন্থী প্রচারণায় ব্যস্ত, আর ভিন্ন কণ্ঠগুলোকে দমন করা হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদের সামাজিক প্রভাবও গভীর। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক শুধু রাজনীতিতে নয়, দৈনন্দিন জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একসময় প্রতিবেশী হিসেবে যেসব হিন্দু-মুসলিম একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে থাকতেন, এখন অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সন্দেহ ও শত্রুতার দেয়াল তৈরি হচ্ছে। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে বাজার, অফিস, গণপরিবহন—সবখানেই এই বিভাজনের ছাপ পড়ছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় সমাজকে আরও ভঙ্গুর করে তুলতে পারে।
তবে এটিও মনে রাখতে হবে যে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতাও ভারতে বিদ্যমান। দেশের বহু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন ও সাধারণ মানুষ এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ভারতের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। হিন্দু ধর্মের মধ্যেও অসংখ্য সংস্কারক ও সাধক ছিলেন, যাঁরা ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা ও ভালোবাসার বার্তা দিয়েছেন। তাঁদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যই হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে।
অতএব বলা যায়, হিন্দুত্ববাদ ভারতের জন্য একটি দ্বিমুখী সংকট তৈরি করেছে। একদিকে এটি রাজনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যা নির্বাচন জেতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। অন্যদিকে এটি ভারতের সামাজিক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক বহুত্ব এবং গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম যদি এই সংকীর্ণ মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে, তবে ভারত তার সহস্র বছরের ঐতিহ্য, যেখানে ভিন্নতা সত্ত্বেও একসাথে বসবাস করার শিক্ষা পাওয়া গেছে, তা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। হিন্দুত্ববাদ কেবল একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, যা যদি অপ্রতিরোধ্যভাবে চলতে থাকে, তবে ভারতের ভবিষ্যৎ আরও সংঘাতময় ও বিভক্ত হয়ে উঠবে।
এই বাস্তবতায় প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক সম্মানবোধ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা। ভারতের নাগরিকদের উচিত নিজেদের বহুত্ববাদী শিকড়কে আঁকড়ে ধরা, কারণ সেই ঐতিহ্যই পারে দেশকে টিকিয়ে রাখতে। হিন্দুত্ববাদ সাময়িকভাবে শক্তিশালী হলেও ভারতবর্ষের আত্মা নিহিত রয়েছে তার বহুত্বে। এই আত্মাকে রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
আপনার মতামত জানানঃ