তাজমহল বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়, প্রেম ও শিল্পকলার প্রতীক। কিন্তু আজকের ভারতে এটি আর শুধু প্রেমের স্মারক নয়—বরং রাজনৈতিক ঘৃণার একটি অস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে “দ্য তাজ স্টোরি” নামের সিনেমাকে ঘিরে যে বিতর্ক ছড়িয়েছে, তা ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নতুন মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই সিনেমাকে ঘিরে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেটি শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়; বরং একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ, যার লক্ষ্য ইতিহাসকে বিকৃত করে ধর্মীয় বিভাজনকে আরও গভীর করা।
“দ্য তাজ স্টোরি” সিনেমায় বলিউড অভিনেতা পরেশ রাওয়াল অভিনয় করেছেন। পোস্টারে দেখা যায়, তিনি তাজমহলের গম্বুজ খুলে তার ভেতর থেকে শিবের মূর্তি বের করছেন। এই দৃশ্যের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, তাজমহল নাকি আসলে “তেজো মহালায়া”—একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির, যা শাহজাহান দখল করেছিলেন। এমন মিথ্যা কাহিনি দিয়ে সিনেমাটি হিন্দু ধর্মের গৌরব ফেরানোর নামে মুসলিম শাসনামলের ঐতিহাসিক স্থাপনাকে অপমান করছে। ইতিহাসের বিকৃতি ও ধর্মীয় উসকানির এই প্রবণতা শুধু সিনেমার পর্দায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
তাজমহল নিয়ে এই গল্প নতুন নয়। ষাটের দশকে পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামের এক প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা প্রথম দাবি করেন, তাজমহল ছিল শিবমন্দির। তিনি পরবর্তীতে বই লেখেন “তাজমহল: ট্রু স্টোরি” নামে। সেই বই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম ভিত্তি হয়ে ওঠে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই মিথের পুনর্জাগরণ ঘটে। আদালতে একের পর এক মামলা হয়—তাজমহলের ভেতরের কক্ষ খুলে দেখা হোক, সেখানে নাকি হিন্দু দেবতার নিদর্শন আছে। কিন্তু আদালত বারবার এসব মামলা বাতিল করেছে। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, তাজমহলের নিচে কোনো মন্দির ছিল না, কোনো ধর্মীয় প্রতীকও পাওয়া যায়নি। তবুও এই মিথ থামছে না। কারণ এটি রাজনৈতিকভাবে লাভজনক।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এবং বিজেপির জন্য ইতিহাস পুনর্লিখন একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। মুসলিম শাসকদের তৈরি স্থাপনা ও ঐতিহ্যকে বিকৃত করে দেখানো তাদের কৌশল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তারা আরও উগ্র হয়ে ওঠে। এখন লক্ষ্য তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লা—যে সব স্থাপনা ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের প্রতীক। এসব স্থাপনাকে হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, যেন মুসলিম শাসকদের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা যায়। এর মধ্যেই “দ্য তাজ স্টোরি”-র মতো সিনেমা তৈরি হচ্ছে, যা দর্শকের আবেগকে ব্যবহার করে ঘৃণা ছড়াচ্ছে।
এই সিনেমার প্রযোজক সুরেশ ঝা আগে বানিয়েছিলেন “মোদি কা গাঁও”, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় ভরপুর ছিল। এবার তিনি তাজমহল নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ধর্মীয় আবেগে আগুন ধরাচ্ছেন। এটি কেবল একটি সিনেমা নয়—এটি একটি রাজনৈতিক প্রচারণা, যেখানে ইতিহাসের জায়গায় কল্পনা বসানো হয়েছে। সিনেমার ভাষায় ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, আর সেটিই ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বলিউড একসময় ছিল ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু এখন সেটিও রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে গেছে। যারা সরকারের সমালোচনা করে, তারা “দেশদ্রোহী” বলে অভিযুক্ত হয়; আর যারা ঘৃণার গল্প বানায়, তারা সরকারি পুরস্কার পায়। পরেশ রাওয়াল যেমন একদিকে দক্ষ অভিনেতা, অন্যদিকে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, “দ্য তাজ স্টোরি”-তে অভিনয় করে তিনি আবারও রাজনৈতিক টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে শিল্পকলাকে রাজনৈতিক প্রচারের পথে নামিয়ে আনা হচ্ছে।
তাজমহল শুধু স্থাপত্য নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতার সমন্বয়, প্রেম ও সৃজনশীলতার প্রতীক। মোগল স্থাপত্যের উৎকর্ষে নির্মিত এই স্থাপনাকে যারা মন্দিরে রূপান্তর করতে চায়, তারা আসলে ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের ওপর আঘাত করছে। ইতিহাসকে বিকৃত করে তারা এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ চালাচ্ছে—যাতে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বাড়ে এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ভয় বা ক্রোধ তৈরি হয়। এই ভয় ও ঘৃণাই ভোটবাক্সে পরিণত হয় রাজনৈতিক শক্তিতে।
ভারতের আদালত ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, তাজমহল নিয়ে কোনো ধর্মীয় রহস্য নেই। কিন্তু আরএসএস ও বিজেপির প্রচারযন্ত্র এসব যুক্তিকে উপেক্ষা করছে। তারা জানে, মানুষ তথ্য নয়, আবেগে বিশ্বাস করে। তাই সিনেমা, সামাজিক মাধ্যম, রাজনৈতিক বক্তব্য—সব জায়গায় একই গল্প পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে: “তাজমহল ছিল হিন্দুদের সম্পত্তি, মুসলমানরা সেটা দখল করেছে।” এই গল্প বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটি ক্রমে সামাজিক বাস্তবতায় ঢুকে পড়ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় রাজনীতির এই বিষবীজ ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—সব দেশেই ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে এই প্রবণতা সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ, এখানকার শিল্প, সাহিত্য ও সিনেমা সবসময়ই মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। “দ্য তাজ স্টোরি”-র মতো একটি ছবি তাই শুধু একটি প্রোপাগান্ডা নয়—এটি একটি সামাজিক প্রভাব বিস্তারের অভিযান।
তাজমহলকে কেন্দ্র করে যে মিথ তৈরি করা হচ্ছে, তা কেবল একটি স্থাপনাকে নয়, পুরো মুসলিম ঐতিহ্যকেই আঘাত করছে। শাহজাহান ও মুমতাজের প্রেমকাহিনি, মোগল স্থাপত্যের নান্দনিকতা, ভারতীয় কারুশিল্পের ইতিহাস—সবকিছুই একে ঘিরে তৈরি হয়েছে। আজ সেটিকে ধর্মীয় প্রতীকে পরিণত করে ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর ফলে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আরও বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, আর সংখ্যাগুরুদের মধ্যে বাড়ছে অহংকার ও অবিশ্বাস।
তাজমহলের মতো একটি নিদর্শন নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি করা মানে আসলে ভারতের সংস্কৃতির আত্মাকে আঘাত করা। হাজার বছরের মিলিত ঐতিহ্যের দেশটিকে টুকরো টুকরো করে বিভক্ত করার এই প্রচেষ্টা একদিন ভারতের সমাজকাঠামোকেই ধ্বংস করবে। রাজনীতির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা যত সহজ, তার ফল তত ভয়াবহ। ইতিহাস বদলানো যায় না; কিন্তু যারা তা নিয়ে খেলছে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেদের হাস্যকর ও বিপজ্জনক করে তুলছে।
আজকের ভারত এক ভয়ানক সময় পার করছে—যেখানে ভালোবাসার প্রতীককে ঘৃণার প্রতীকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। “দ্য তাজ স্টোরি” কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি ভারতের গণতন্ত্র, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। তাজমহল এখন শুধু শাহজাহানের স্মারক নয়—এটি সত্য ও মিথ্যার, ভালোবাসা ও ঘৃণার, মানবতা ও রাজনীতির লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আপনার মতামত জানানঃ