ভারতে গরুর মাংস রপ্তানি একটি আজব বৈপরীত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। একদিকে গরুকে “গোমাতা” বলে পুজো করা হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে গরু ও মহিষের মাংস বিক্রি করে ভারত এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে দ্বিচারিতা, রাজনীতির সুযোগসন্ধান, আর্থিক বাস্তবতা এবং সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের কাহিনি।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগে গোমাংস রপ্তানিকে “পিঙ্ক রেভল্যুশন” বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস সরকার মুসলিমদের খুশি করতে এই ব্যবসা বাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাঁর শাসনামলেই গোমাংস রপ্তানি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টনের বেশি গরু-মহিষের মাংস বিদেশে যাচ্ছে, আয় হচ্ছে শত শত কোটি ডলার। বৈশ্বিক বাজারে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোতে এর বিপুল চাহিদা।
কিন্তু একই সময়ে ভারতের ভেতরে মুসলিমদের উপর চলছে এক ভিন্ন চিত্র। গরু হত্যার অভিযোগে মুসলিম যুবককে গ্রামবাসীর হাতে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, গোরক্ষক বাহিনী প্রকাশ্যে লিঞ্চিং চালাচ্ছে। অসংখ্য ভিডিওতে দেখা গেছে, মুসলিমদের দাড়ি টেনে টেনে মারধর করা হচ্ছে, কেবল সন্দেহের বশে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে। উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থানসহ বহু রাজ্যে এভাবে বহু প্রাণ হারিয়েছে মুসলিমরা। অথচ এই মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতেই বেশি থাকে কসাইখানা ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। তারা শ্রম দিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ খুলছে, কিন্তু নিজেরাই দেশের ভেতরে সন্ত্রাস ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্ট: মাংস রপ্তানি ভারতের জন্য এক বড় বৈদেশিক আয়ের উৎস। তাই রাজনৈতিক বক্তৃতায় যতই হিন্দুত্ববাদ জাহির করা হোক না কেন, বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ ছাড়া এই শিল্প এতটা প্রসারিত হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের শীর্ষ মাংস রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোর মালিকানা বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়, মুসলিম নয় বরং হিন্দুরাই অধিকাংশ কোম্পানির মালিক। আল-কাবির, অ্যারাবিয়ান এক্সপোর্টস বা এম.কে.আর ফ্রোজেন ফুড—সবখানেই হিন্দু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করছেন। ধর্মীয় ভেদাভেদ যাদের হাতিয়ার, তারাই অর্থনৈতিক স্বার্থে গোমাংস বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছেন।
এখানে দ্বিচারিতার চিত্রটি আরও প্রকট হয় যখন দেখা যায়, রপ্তানিকৃত সব মাংস হালাল সার্টিফিকেশন নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে যাচ্ছে, যাতে মুসলিম গ্রাহকদের কাছে বিক্রি বাড়ানো যায়। কিন্তু দেশের ভেতরে হালাল সার্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বিজেপি সরকার হালালপন্থী উদ্যোগকে “মুসলিমকেন্দ্রিক প্রথা” বলে আক্রমণ করছে, অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য ঠিক সেই মান বজায় রেখেই ব্যবসা চালানো হচ্ছে।
মোদির ভারত তাই এক দ্বিমুখী বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একদিকে রাজনৈতিক লাভের জন্য মুসলিমদের উপর দমননীতি চালানো হচ্ছে—মিথ্যা গরু জবাইয়ের অভিযোগে হত্যা, ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন। অন্যদিকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একই মুসলিম শ্রমশক্তির ঘামে ভিজে তৈরি হচ্ছে রপ্তানি প্যাকেজ, যা দেশকে বৈদেশিক মুদ্রায় সমৃদ্ধ করছে।
এই বৈপরীত্য কেবল একটি ধর্মীয় সংকট নয়, এটি সামাজিক ন্যায্যতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও। যে রাষ্ট্রের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, সেই রাষ্ট্রেই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, অথচ সেই একই গরুর মাংস বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার আয় করা হচ্ছে। আর এই দ্বিচারিতা এমন এক সময়কে সামনে আনছে, যখন অর্থনীতি আর রাজনীতির মাঝে আটকে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
গরু তাই ভারতে আর কেবল প্রাণী নয়; এটি হয়ে উঠেছে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের প্রতীক। গোমাতা পূজা ও গোমাংস রপ্তানি—এই দুইয়ের টানাপোড়েন আসলে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে থাকা ভণ্ডামির ছবি তুলে ধরছে। মুসলিমদের রক্ত আর শ্রমের বিনিময়ে দাঁড়িয়ে আছে যে রপ্তানি রেকর্ড, সেটিই প্রমাণ করছে এই শিল্পের মূল চালিকা শক্তি অর্থ, ধর্ম নয়।
এই বৈপরীত্যকে আলোচনায় না আনলে ভারতের সমাজে বাড়তে থাকা ফাটল বোঝা যাবে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লোভ ও ধর্মীয় রাজনীতির দ্বিচারিতা একসাথে চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেবল মানবিক মূল্যবোধই নয়, দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতাও। ভারতের এই গোমাংস রপ্তানি কাহিনি তাই শুধু অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প নয়, এটি ধর্মীয় ভণ্ডামি, নিপীড়ন ও দ্বিচারিতার এক বেদনাদায়ক দলিল।
আপনার মতামত জানানঃ