বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা এবং অভিন্ন কৌশলগত স্বার্থের সম্ভাবনা নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান জেনারেল অনিল চৌহানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ভারতের উদ্বেগকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তিনি মনে করেন, এই তিন দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়ার সুযোগকে চীন বিশেষভাবে ব্যবহার করতে পারে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে। ভারতের দৃষ্টিতে, এটি শুধু প্রতিবেশী কূটনৈতিক ভারসাম্যের প্রশ্ন নয়; বরং একটি সম্ভাব্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ।
চীন ও পাকিস্তান বহুদিন ধরেই একে অপরের কৌশলগত মিত্র। সামরিক সহযোগিতা, অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং কূটনৈতিক সমর্থনে তারা প্রায়ই একে অপরের পাশে থাকে। এদিকে, বাংলাদেশকে ঘিরে চীনের সক্রিয়তা—বিশেষত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ—ভারতের কূটনীতিক ও সামরিক মহলে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, চীন কি বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের ‘পেছন দিক’ থেকে চাপ প্রয়োগের কৌশল নিচ্ছে?
জেনারেল চৌহানের বক্তব্যে এই শঙ্কাই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সরাসরি কোনও দেশের নাম উল্লেখ না করলেও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতে চীনের ‘প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা’ যে ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তা স্পষ্ট করেছেন। আর সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাঙ্গেল থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তিনি ‘অপারেশন সিন্দুর’ প্রসঙ্গও তুলেছেন, যা পাকিস্তানের ভেতরে ভারতীয় বাহিনীর সামরিক অভিযানের নাম। যদিও এই অভিযান সম্পর্কে নির্দিষ্ট বিস্তারিত এখনও গোপন, তবে এটিই ইতিহাসে প্রথমবার, যখন দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে চীনের ভূমিকা এবং সহায়তা কতটুকু ছিল, তা নির্ধারণ করা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন জেনারেল চৌহান। তবে এই সংঘাতের সময় ভারতের উত্তর সীমান্তে (যেখানে চীনের অবস্থান) ‘অস্বাভাবিক তৎপরতা’ না থাকাও তার মতে উল্লেখযোগ্য বিষয়।
এটি কেবল ভারত-পাকিস্তান বা ভারত-চীন সম্পর্কের প্রেক্ষাপট নয়; বরং একটি ত্রিদেশীয় সম্ভাব্য অক্ষ—বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান—যেটি ভারতের জন্য একটি নতুন ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ভারতের আশঙ্কা, যদি চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে চায়, তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা কৌশলগত সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে।
চৌহান এই আলোচনায় আরও বলেন, ভবিষ্যতের যুদ্ধে কেবল প্রচলিত যুদ্ধ নয়, সাইবার ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক যুদ্ধের মতো নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক লড়াইও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি জানান, ভারতের পারমাণবিক নীতি এখনও ‘প্রথমে ব্যবহার না করার’ (No First Use) নীতির ওপরই নির্ভরশীল। তবে তা সত্ত্বেও, ভারত যে সম্ভাব্য সব ধরণের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, সে কথাও তিনি জোর দিয়ে বলেন।
জেনারেল চৌহান স্পষ্ট করে দেন, ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি প্রতিরোধমূলক, আক্রমণাত্মক নয়। অস্ত্র ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রতিরোধ গঠন করা, যুদ্ধ চালানো নয়। কিন্তু যদি শত্রুপক্ষ যুদ্ধকে বাধ্যতামূলক করে তোলে, তবে ভারত তাতে পিছিয়ে থাকবে না।
কাশ্মিরের পেহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত যে ‘প্রতিশোধমূলক’ বা ‘প্রতিরোধমূলক’ পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা পাকিস্তানের কিছু ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল বলেও দাবি করেন তিনি। তার ভাষ্য মতে, ভারত শুরুতে প্রতিক্রিয়া দেখালেও, পাকিস্তান পরে বিষয়টিকে প্রচলিত যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
এই পুরো আলোচনা ভারতের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিরাপত্তা নীতির একটি গভীর ইঙ্গিত দেয়। ভারত এখন তার কৌশলগত পরিবেশে নতুন বাস্তবতা দেখছে—যেখানে কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক অক্ষও তার নিরাপত্তা নীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ধারাবাহিকতার মধ্যে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গতিবিধিও তাই ভারতের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না।
এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশ কিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখে, সেটাই হয়তো পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, ভারত নিজেও তার প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক কৌশলকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর পথে অগ্রসর হচ্ছে—বিশেষত পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীদের সম্ভাব্য সম্মিলিত কৌশলগত অবস্থানকে সামনে রেখে।
আপনার মতামত জানানঃ