বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় কাকরাইল মোড়ে বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা টানা তিন দিন অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের দাবি ছিল, ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হোক। একইসঙ্গে তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। এই বিক্ষোভ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান উত্তেজনার একটি বড় উদাহরণ।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু তাঁর সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সংস্কার, এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ইউনূস সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনার স্বচ্ছতা ও নির্দিষ্টতার অভাবে রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর জাতীয় ঐক্যের সরকারের ঘোষণা এলেও, সংস্কারে বিলম্ব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভাজন সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইউনূস সরকার যেসব সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার অনেকটাই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূস জানিয়েছেন যে আগামী ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখনো পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা করা হয়নি, যা বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি করেছে। বিএনপি জানিয়েছে, একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া ইউনূস সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার বক্তব্যে বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরেই হওয়া উচিত। তিনি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংস্কার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই মন্তব্য সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে, গত বছরের অভ্যুত্থানের সময় নেতৃত্বে থাকা তরুণদের গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জোর দিয়ে বলেছে, যথাযথ সংস্কার ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করা উচিত হবে না।
সংস্কার প্রক্রিয়ায়ও অগ্রগতি নেই বললেই চলে। অধ্যাপক ইউনূস তাঁর সরকার গঠনের পর ছয়টি আলাদা সংস্কার কমিশন গঠন করেন এবং তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের প্রথম দফার সংলাপে বেশ কিছু সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমর্থন পাওয়া গেছে, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। তবে আরও জটিল কিছু সংস্কারের বিষয়ে, যেমন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
সংলাপের দ্বিতীয় ধাপ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, তবে রাজনৈতিক পরিবেশ যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তাতে সে সংলাপ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। একদিকে সরকার সময়ক্ষেপণ করছে, অন্যদিকে বিরোধীরা চাপে রাখছে। এই টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক নেই। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীরা নিয়মিত বিক্ষোভ করছেন। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। তারা মনে করছেন, যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য না হয়, তাহলে এই অস্থিরতা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সরকারের ওপর আরেকটি বড় চাপ এসেছে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পর। এতে দলটি কার্যত আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যদিও ইউনূস সরকার এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করছে, তবে অনেকেই এটিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে বাধা হিসেবে দেখছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। তিনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর যারা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তারাই এই সংকটের জন্য দায়ী। তবে এমন বক্তব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করার চেয়ে বরং উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই জটিল পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ আশায় তাকিয়ে আছে একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, কার্যকর সংস্কার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এখন সময় একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে সবার একতাবদ্ধ হওয়ার।
আপনার মতামত জানানঃ