বাংলাদেশে করোনা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে আবেদন করেছে তিন প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান, অন্য দুটি বিদেশি। একটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে প্রথম ফেজ থেকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান দেশে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করবে। আবেদনগুলো বিএমআরসি (বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল) গ্রহণ করেছে। তবে সেগুলো কোন অবস্থায় আছে বা অনুমোদন পাবে কিনা সে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিএমআরসি সূত্রে জানা গেছে, এর আগে বাংলাদেশে বা বিএমআরসিতে এ ধরনের আবেদন হয়নি। এবারই প্রথম কোন ওষুধের ফার্স্ট ফেজ ট্রায়াল পরিচালনার জন্য আবেদন এসেছে। এছাড়া আরও দুটি কোম্পানি থার্ড ফেজ ট্রায়াল বা মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য আবেদন করেছে। বৈশ্বিক মহামারিতে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনা করে এগুলো দ্রুততার সঙ্গে রিভিউ করা যেতে পারে। যেভাবে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান এফডিএ প্রতিদিন ৩ শিফটে ২৪ ঘণ্টা রিভিউয়ার দিয়ে রিভিউ করিয়ে ফাইজার ও মর্ডানার টিকার ট্রায়াল পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেটি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে করোনা টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল পরিচালনা করতে চায় চায়নার ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজি চাইনিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্স (আইএমবিসিএএমএস)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে করেনাভাইরাস প্রতিরোধে একটি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’ উদ্ভাবনের কাজ শুরু করে। ইতোমধ্যে সার্সকোভ-২ নামের একটি টিকা উদ্ভাবন করেছে। যা আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসারে প্রাণীদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এবং মানবদেহে পরীক্ষামূলক ফেজ-১ ও ফেজ-২ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনার জন্য ওয়ান ফার্মার পক্ষ থেকে ২৩ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর একটি আবেদন করা হয়। অনুমতি পেলে ৮ হাজার জনগোষ্ঠীর ওপর এই ট্রায়াল পরিচালিত হবে। এটি পরিচালনায় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র- আইসিডিডিআরবি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া দেশীয় বেসরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ান ফার্মাকে স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করেছে।
এদিকে ভারত বায়োটেক নামে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান করোনা টিকা উদ্ভাবন করেছে। এটিও একটি ‘ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন’। ইতোমধ্যে এর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল পরিচালনার জন্য বিএমআরসিতে আবেদন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের ক্লিনিক্যাল রিসার্চ করার জন্য আইসিডিডিআরবির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। তারা জানান, একটি ভারতীয় এবং একটি চায়না টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল পরিচালনায় তারা চুক্তি করেছে। চুক্তির শর্ত অনুসারে তারা কোনো ধরনের মন্তব্য করতে পারবে না। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এদিকে ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক তাদের উৎপাদিত করোনাভাইরাস টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ-বিএমআরসিতে এই আবেদন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনুমোদন পাওয়ার পর সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকের ওপর টিকার পরীক্ষামূলক প্রথম প্রয়োগ বা ফার্স্ট ট্রায়াল পরিচালনা করা হবে।
গ্লোব বায়োটেকের গবেষণা কর্মকর্তা ড. আসিফ মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর আবেদনটি তাদের পক্ষ থেকে করেছে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মানবদেহে প্রথম ট্রায়াল পরিচালনার জন্য আবেদন করা হলেও এখনো বিএমআরসি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু জানানো হয়নি। তবে এই মাসের শেষে বা আগামী মাসের শুরুতে কোনো ইতিবাচক সংবাদ পাবেন বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি তো জটিল নয়। টিকার মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ক্ষেত্রে যত বেশি ট্রায়াল পরিচালনা করা হবে ততই ভালো। ট্রায়ালে যদি অবস্থা ভালো হয়, তাহলে আমরা ওই টিকা নেব। ভালো না হলে নেব না। ভালো হলে, উৎপাদনের জন্য আমাদের দেশের কোনো কোম্পানিকেও লাইসেন্স দিতে বলা যেতে পারে । কারণ দেশে উৎপাদিত হলে দাম কম হওয়ার সুবিধাটাও আমরা পাব।
এদিকে ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে এক ডোজ ভ্যাকসিন দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে শুরু করেছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা দেয়ার কর্মসূচি। প্রথম দিনে মোট ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। বুধবার বিকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
এরপরেই প্রথম টিকা নেয়া বাংলাদেশে প্রথম টিকা নেয়া ব্যক্তি রুনু ভেরোনিকা কস্তার গণমাধ্যমকে বলছিলেন যে তিনি চান তাকে দেখে বাংলাদেশের মানুষ যেন টিকা নিতে অনুপ্রাণিত হন এবং তাদের মনের ভেতর যেন ভ্যাকসিন নিয়ে কোন ভয়ভীতি না থাকে। তিনি বলেন, ”ভ্যাকসিন যখন আমাদের দেশে সহজলভ্য হবে, তারা যেন নিঃসন্দেহে এই ভ্যাকসিন নিয়ে নেন। এভাবে আমরা সবাই দেশকে করোনামুক্ত করার চেষ্টা করবো।”
একজন ফ্রন্টলাইনার হিসেবে তাকে যে টিকাটি তাদের দেয়া হয়েছে, সেটির উদ্ভাবক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, আর ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটে এটি তৈরি হয়েছে কোভিশিল্ড ব্র্যান্ড নাম নিয়ে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশে ভ্যাকসিন কর্মসূচি শুরু হলেও টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে অনীহার কথা প্রকাশ পেয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ টিকা সম্পর্কিত একটি জরিপ চালিয়েছে। ওই জরিপে দেখা যায় যে বাংলাদেশের মাত্র ৩২ শতাংশ মানুষ টিকা কার্যক্রমের একেবারে শুরুতে টিকা নিতে আগ্রহী। আরও ৫২ শতাংশ আগ্রহী, তবে তারা এখনই নয়, বরং দেখে শুনে পরে নিতে চান।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১২০৯
আপনার মতামত জানানঃ