গত ২২শে এপ্রিল পহেলগামের বৈসারণ উপত্যকায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ২৬ জনের একজন কানপুরের শুভম দ্বিবেদী। তার স্ত্রী ২৯- বছরের ঐশান্যা জানান, “আমাদের দেশ, আমাদের সরকার আমাদের ওখানে (পহেলগামে) অনাথের মতো ছেড়ে দিয়েছিল। যাদের ওপর ভরসা করে আমরা ওখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম, তারা সেই সময় ওখানে উপস্থিত ছিল না।”
“কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছিল না, কোনো জওয়ান ছিল না। ঘরের ভেতরে বাবা-মা আমাদের রক্ষা করতে পারেন, কিন্তু ঘরের বাইরে আমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের,” ঘটনার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এ কথা বলেছেন।
ঐশান্যা জানান, শুভম দ্বিবেদীর পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল ‘ইনস্ট্যান্ট নুডলস’। গত ১৭ই এপ্রিল প্রথমবার পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতশাসিত কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ফেরার কথা ছিল ২৩শে এপ্রিল। ফিরে আসার আগের দিন, অর্থাৎ ২২শে এপ্রিল পহেলগামে ঘুরতে যান তারা। যেদিন শুভম দ্বিবেদীকে হত্যা করা হয়, সেদিনই ছিল কাশ্মীরে দ্বিবেদী পরিবারের শেষ দিন।
ভ্রমণের প্রস্তুতির কথা মনে করে তার স্ত্রী বলেছেন, “বিয়ের পর শুভম এক বছরে দু’টো ফ্যামিলি ট্রিপ (পারিবারিক ভ্রমণের) প্ল্যান করেছিল। এটাই ছিল আমাদের প্রথম ফ্যামিলি ট্রিপ।”
“কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে সেটা বাছতে সবার ভোট নেওয়া হয়েছিল। সবাই মিলে কাশ্মীরকে বেছে নিয়েছিলাম। আমরা জানতাম না কাশ্মীর আমাদের জন্য এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।”
তিনি বলেন, “সরকার তো বলে কাশ্মীর এখন নিরাপদ। সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়েছে। কোনোরকম দুশ্চিন্তা ছাড়াই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। জানতাম না যে আমাদের পৃথিবী সেখানে শেষ হয়ে যাবে।”
কাশ্মীর সফরে মি দ্বিবেদীর স্ত্রী, বাবা-মা, বোন, তার শ্বশুর-শাশুড়ি, ঐশান্যার বাবা-মা, বোন-সহ মোট ১১ জন ছিলেন।
যে সময় ঘটনাটা ঘটে, তখন মি. দ্বিবেদীর সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী ঐশান্যা, ঐশান্যার ছোট বোন সম্ভাবী এবং তাদের দুই জনের বাবা-মা-সহ মোট পাঁচজন। পরিবারের বাকি ছয় সদস্য মাঝপথ থেকে বৈসারণ উপত্যকায় ফিরে এসেছিলেন।
শুভমের ছোট বোন আরতি, যার বিয়ে হয়েছিল দুই বছর আগে, তিনি ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই আর ওপরে উঠতে চাননি। তিনি যেতে না চাওয়ায় পরিবারের অন্য পাঁচজন সদস্যও সেখানে যাননি।
ঐশান্যা বলেছেন, “বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর পর আমাদের এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে যারা সন্ত্রাসীদের বলেছিল, আমাদেরও গুলি করো যেভাবে আমাদের স্বামীকে মেরে ফেলেছ। কিন্তু তারা বলেছে–– যাও আর তোমার সরকারকে বলো আমরা তোমার স্বামীর সঙ্গে কী করেছি।”
“সন্ত্রাসীদের ওই কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল তাদের রাগ সরকারের ওপর, কিন্তু মারা হয়েছে নিরীহ মানুষগুলোকে।”
“তখন ঘড়িতে দুপুর ২টা ২৫ মিনিট বাজে। হাওয়ায় গুলি চলেছিল, আমরা সেই শব্দটা শুনেছি। কফি বিক্রেতা চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই একজন আমাদের কাছে এসে শুভমকে জিজ্ঞেস করল- হিন্দু না মুসলমান?”
“ভেবেছিলাম কেউ আমাদের সঙ্গে প্র্যাঙ্ক (মশকরা) করছে। আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? লোকটা আবার জানতে চাইল- হিন্দু না মুসলমান? বলল, যদি মুসলমান হও তাহলে কলমা পড়। আমরা তখনও ভাবছি যে কেউ মজা করছে।”
“আমাদের আর শুভমের মুখ থেকে হিন্দু বেরিয়ে এসেছে। আমরা আমাদের বাক্য শেষও করতে পারিনি, (হামলাকারী) শুভমের মাথার বাঁ দিকে গুলি চালিয়ে দিল।” কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন ঐশান্যা। শব্দ হারিয়ে ফেলছিলেন।
কোনোমতে তিনি বলেন, “গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ও পড়ে গিয়েছিল। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। তার চেহারার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না প্রায়। খালি মাংসপিণ্ড আর রক্ত ছিল। তারপর কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।”
যে সময় শুভম দ্বিবেদীর গুলি লাগে সেই সময়কার ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন সম্ভাবী। তার কথায়, “আমার জামাইবাবুর গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে থাকা ১০০-১৫০ জন এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে। প্রথমে অন্য কেউ গুলিবিদ্ধ হলে হয়তো আমরা পালিয়ে বাঁচতে পারতাম।” শুধু ধর্মের কারণে শুভম দ্বিবেদীকে মেরে ফেলা হয় এই অভিযোগকে ঘিরেই ব্যাপক ক্ষুব্ধ তিনি।
ঘটনার আগে কাশ্মীর সফরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “কাশ্মীরে আমরা সবাই অনেক মজা করেছি। আমার দিদির বিয়ে হয়েছে মাত্র দুই মাস। কিন্তু এই দুই মাসে উনি (শুভম) আমার দিদিকে অনেক জায়গায় ঘুরিয়ে এনেছে।”
“কাশ্মীর সফরে এসে এরপর দ্বিতীয় ট্রিপে প্যারিস যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল (শুভম)। দিদিকে বলেছিল বিয়ের ষষ্ঠ মাস উদযাপন করতে প্যারিস নিয়ে যাবে।”
ঐশান্যা দ্বিবেদী বিকম পাশ করেছেন। তিনি নাচ করেন, অনেক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই নাচের ক্লাস শুরু করারও কথা ছিল।
শুভম দ্বিবেদীর আদি গ্রাম রুমায়, কানপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম। এই মুহূর্তে তাদের বাড়িতে গেলে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই পরিবারের অনেককে বসে থাকতে দেখা যাবে।
দরজা দিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়বে একটা সাদা চাদর বিছানো টেবিল। তার ওপরে রাখা আছে মালা পড়ানো প্রয়াত শুভম দ্বিবেদীর ছবি।
শুভমের চাচাতো ভাই সৌরভ বলছিলেন, “সরকারকে সন্ত্রাসবাদকে গোড়া থেকে নির্মূল করতে হবে এবং ভারতের প্রত্যেক নাগরিককে আশ্বস্ত করতে হবে যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যেখানেই থাকুন না কেন আপনি নিরাপদ।”
আপনার মতামত জানানঃ