এখন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, ভারত কী একতরফাভাবে পাকিস্তানে পানির প্রবাহ ‘বন্ধ’ করতে পারে? তাৎক্ষণিকভাবে সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, ‘না’। উচ্চ প্রবাহের মৌসুমে পানির চলাচলে উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে, সেই মাত্রায় পানির প্রবাহ বন্ধের কোনো এখতিয়ার ভারতের নেই।
সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব অনেক বড় নদী। মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তুষার গলে এই নদীগুলোতে কয়েক শ কোটি ঘনমিটার জল পরিবাহিত হয়। ভারতে এই নদীগুলোর উজানে বাগলিহার ও কিষাণগঙ্গা বাঁধসহ কিছু অবকাঠামো রয়েছে। কিন্তু এসব অবকাঠামোর কোনোটি এত বেশি পরিমাণে পানি ধরে রাখার জন্য নকশা করা হয়নি। এগুলো এমন কিছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা সীমিত পানি সংরক্ষণ করেই পরিচালিত হয়। এসব প্রকল্পের প্রভাব এতই সামান্য যে ভারত যদি সমন্বয় করে একযোগে সব বাঁধের পানিও ছাড়ে, তাতেও নদীগুলোর প্রবাহের সময়ে কেবল সামান্য পরিবর্তন আসবে।
উল্লিখিত উচ্চপ্রবাহের সময়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানির মোট পরিমাণ এত বেশি হয় যে তারা নিজেদের উজানের অঞ্চলগুলোকে প্লাবিত করে ফেলে। তবে চুক্তি অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলোর বরাদ্দ করা বেশির ভাগ প্রবাহ আগে থেকেই ভারত ব্যবহার করে আসছে। তাই নদীগুলোর ওপর নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে, ভাটিতে তাদের প্রভাব আরও সীমিত হয়ে আসবে।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি ধরে রাখার যে সুযোগ-সুবিধা আছে, তা সীমিত ও ভূতাত্ত্বিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। নতুন সুযোগ-সুবিধা নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থেরও দরকার আছে। রাজনৈতিক ঝুঁকি আরও বেশি।
তবে শুষ্ক মৌসুম নিয়েই সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। কারণ, তখন অববাহিকাজুড়ে পানির প্রবাহ কমে যায়, ফলে পানি ধরে রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সময়ের হিসাবটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই চুক্তি কার্যকর না থাকলে শুষ্ক মৌসুমে কী হবে, সেটাই বড় ভাবনার বিষয়।
মধ্য থেকে দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। ভারত চুক্তির কাঠামোর বাইরে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে তা নতুন অবকাঠামো তৈরির দরজা খুলে দেবে, যা পাকিস্তান অংশের প্রবাহের সময় এবং পানির পরিমাণের ওপর [ভারতকে] আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেবে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। যেকোনো বৃহৎ আকারের বাঁধ বা পানি অন্যদিকে সরানোর প্রকল্প নির্মাণ করতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি ধরে রাখার যে সুযোগ-সুবিধা আছে, তা সীমিত ও ভূতাত্ত্বিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। নতুন সুযোগ-সুবিধা নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থেরও দরকার আছে। রাজনৈতিক ঝুঁকি আরও বেশি।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোতে ভারতের নতুন বড় ধরনের জলাধার নির্মাণের যেকোনো প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের উসকানি হিসেবে দেখা হবে। আজকের উপগ্রহের যুগে এই ধরনের অবকাঠামোগুলোকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। তা রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সম্ভব হলে সামরিকভাবে মোকাবিলা করা হতে পারে।
সিন্ধু অববাহিকা ঘিরে জলবিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও আছে। চেনাব বা ঝিলামের মতো নদীর উচ্চপ্রবাহ আটকে রাখলে ভারতের উজানের অঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। আর সিন্ধু অববাহিকা থেকে ভারতের অন্যান্য অংশে পানি সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিতে গেলে প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ ও জ্বালানি খরচের প্রয়োজন হবে, যার ন্যায্যতা প্রমাণ উত্তেজনাহীন শান্তির সময়ে বেশ কঠিন হবে।
অববাহিকাসংক্রান্ত জটিলতার বাইরে ওই অঞ্চলে নতুন অবকাঠামো তৈরি হলে সুনাম ও কৌশলগত ঝুঁকিরও বিষয় আছে। ভারত নিজেই ব্রহ্মপুত্র ও চীন থেকে উৎপন্ন অন্যান্য নদীর ভাটি অঞ্চলের দেশ। এই বাস্তবতার কারণেই ভারত ঐতিহাসিকভাবে ভাটি অঞ্চলের অধিকারকে সম্মান করে থাকে। কিন্তু এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়। তাই চুক্তি লঙ্ঘন করে বা চুক্তির বিষয়ে একতরফা কাজ করার মাধ্যমে ভারত এমন নজির স্থাপন করতে যাচ্ছে, যা একদিন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। এমন পদক্ষেপ নিলে ভারতকে যে মূল্য দিতে হবে না, তা বলা যায় না। এই ধরনের পদক্ষেপের পর অন্যান্য আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিজেকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রমাণ করা ভারতের জন্য কঠিন হবে।
ভারত যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, তার ভৌত ও রাজনৈতিক সীমাবদ্ধ থাকলেও চুক্তি সুরক্ষার বিষয়ে এরই মধ্যে আস্থায় যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। এটি এই কারণে নয় যে আগামীকাল থেকে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। বরং তা এই কারণে, যে চুক্তিটি ভারত সমর্থন করেছে, তা কখনোই অনিশ্চয়তার জন্য করা হয়নি। সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের প্রবাহ আমাদের [পাকিস্তানের] কৃষি, শহর ও জ্বালানি ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এই পানির বিকল্প নেই।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভারতের পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার প্রভাব (বাস্তবায়ন হলে) সুদূরপ্রসারী হতে পারে। পাকিস্তানের সেচব্যবস্থা বিশ্বের বৃহত্তম সেচব্যবস্থাগুলোর একটি, যা প্রায় সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর প্রবাহের পূর্বাভাসযোগ্য সময়ের ওপর নির্ভর করে। এসব প্রবাহের ওপর ভিত্তি করেই চারপাশের কৃষকেরা ফসল চাষের পরিকল্পনা করেন। খালের সময়সূচি কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। সেই ছন্দ সামান্য ব্যাহত হলেও জলব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করবে।
পূর্বাভাস নিয়েই সবচেয়ে বড় তাৎক্ষণিক ঝুঁকির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাকিস্তানে আসা পানির মোট পরিমাণ তাৎক্ষণিকভাবে বদলে না গেলেও, সেই পানির আগমনের সময়ে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা প্রকৃতই সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। গম রোপণ মৌসুমে বিলম্ব হলে অথবা শীতের শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে কমে গেলে বপনের সুযোগ হাত ছাড়া হতে পারে, উৎপাদন কমতে পারে বা উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। মিঠাপানির প্রবাহ কমার কারণে সিন্ধু বদ্বীপ এরই মধ্যে সংকুচিত হতে শুরু করেছে। উজানের প্রবাহে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এই সংকোচনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। উপকূলীয় মানুষের জীবিকা ও মৎস্যজীবীদের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
নদীর প্রবাহের সময়সীমার মধ্যে যেকোনো ঘাটতি বা পরিবর্তন প্রদেশকে [পাঞ্জাবকে] পানিবণ্টন নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে। ফলে পাকিস্তানে আন্তপ্রাদেশিক উত্তেজনা তীব্রতর হতে পারে। বিশেষ করে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মধ্যে এই ধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি বেশি। এই দুই প্রদেশের পানিবণ্টন–সম্পর্কিত বিতর্ক রাজনৈতিকভাবে বেশ উত্তপ্ত।
জ্বালানির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে বিদ্যুতের এক-তৃতীয়াংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে, যা তারবেলা, মংলা ও অন্যান্য জলাধারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানি থেকে উৎপাদিত হয়। তাই উজানের প্রবাহ কমানো হলে বা সময়মতো না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা কমতে পারে। এসব আশঙ্কার কোনোটিই অনুমানমূলক নয়। পাকিস্তান এমনিতেই একটি জলস্বল্পতার দেশ।
আপনার মতামত জানানঃ