মামুন আব্দুল্লাহ : মেডিসিন অথবা ভ্যাকসিন দুটোরই সবচেয়ে বড় উৎপাদক হ’ল ভারত। একারণে ভারতকে ফার্মেসি অব দ্য ওয়ার্ল্ড নামেও ডাকা হয়। ইতোমধ্যে ভারত কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতে স্থানীয়দের মাঝে ভ্যাকসিনের ডিম্যান্ড বৃদ্ধির জন্য শুরু থেকেই বাইরে ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করেছে। তারা ভ্যাকসিন এর প্রথম চালান রপ্তানি করে ভুটানে। এর পরপরই আল-জাজিরা, এবিসি সহ সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো ভারতের ভ্যাকসিন রপ্তানিকে হাইলাইট করে সংবাদ প্রচার করতে থাকে। কিন্তু ভারত আসলে করতে চাইছেটা কী? তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী? কোন কোন দেশকে তারা ভ্যাকসিন প্রদান করবে? ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির পয়েন্ট অব ভিউ কী?
যেহেতু ভারতের প্রচুর জনসংখ্যা, এবং করোনা ভাইরাসে ভারত বেশ বিপর্যস্তও তাই বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, তারা সম্ভবত কোভিড ভ্যাকসিন রপ্তানিকে নিষিদ্ধ করবে স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য। কিন্তু তা ঘটেনি, বরং উল্টোটা ঘটেছে। তারা পাকিস্তান বাদে পার্শ্ববর্তী ভুটান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমারে ভ্যাকসিন তো রপ্তানি করবেই সাথে ভারত মহাসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এবং ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও ভ্যাকসিন রপ্তানি করছে। মনে রাখতে হবে, ভারতের যেকোনো একশনের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ভোট ও সমর্থন সবার প্রথমে পায়। ভারত বর্তমানে শুধু মাত্র সিরাম ইনস্টিটিউটের বানানো কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন রপ্তানি করছে। ভারত প্রথম ভ্যাকসিন রপ্তানি করে ভুটানে, এরপর মালদ্বীপ, এরপর নেপাল ও বাংলাদেশকে। অর্থাৎ, উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে বাংলাদেশ বেশ পিছনেই রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন পেয়েছে তবে সেটা শুধু মাত্র জনসংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করে। জনসংখ্যার অনুপাতে ভুটান পেয়েছিল ১ লাখ ডোজ, মালদ্বীপ ১ লাখ ডোজ, নেপাল ১০ লাখ ডোজ ও বাংলাদেশ ২০ লাখ ডোজ।
কিছু স্থানে সন্দেহে থেকে গেছে ভারত থেকে কোন ভ্যাকসিনগুলো আসলে পাঠানো হচ্ছে। কোভিশিল্ড নাকি কোভ্যাক্স? নাকি অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা? উল্লেখ্য কোভিশিল্ড মানবশরীরে কাজ করে মাত্র ৭০%। এর সাইড ইফেক্টও বেশি। এটি প্রয়োগে শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়া শুরু হতে পারে। গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ভ্যাকসিন নিষিদ্ধ। জরুরি হলে, ১৮ বছরের উপরে প্রয়োগ করা যেতে পারে। অপরদিকে কোভ্যাক্স মানবশরীরে প্রায় ৯০% কার্যকরী। এই দুইটি ভ্যাক্সিনই ভারত এখন পর্যন্ত প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিন যদিও অক্সফোর্ডের এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন প্রযুক্তিতে বানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার আগেই নিশ্চিত করেছে সেগুলো কোভিশিল্ডের ভ্যাকসিন। এছাড়া ভারত অনুমানিক দুই কোটি ডোজ ভ্যাকসিন খুব সম্ভবত বিনামূল্যে রপ্তানি করবে নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, সিশেল ও মরিশাসে। ভারত এই কাজটি করছে সুনাম অর্জনের জন্য নাকি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভেঙে পড়া সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য? সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য হলে পাকিস্তানেও তারা ভ্যাকসিন রপ্তানি করত। তবে ভারতের দাবী তারা পাকিস্তানে ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছে না কারণ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কেউ এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন ভারতের নিকট হতে চায়নি। পাকিস্তান বরং সরাসরি চীনের নিকট হতে ভ্যাক্সিন নিতে আগ্রহী।
উন্নত বিশ্বে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যেত। কিন্তু উন্নত বিশ্বে ভ্যাকসিন উৎপাদন না করে ভারতে ভ্যাকসিন উৎপাদনের কারণ হ’ল এটি যেন সকল উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্প উন্নত দেশসমূহের জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকে। উন্নত দেশ সমূহে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বন্টন একটি ব্যয়বহুল প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়াত, ফলে সব ধরণের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মাঝেও এটি থাকত না। ভারতের সাথে ব্রাজিলের ইতোমধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যেখানে ভারত প্রচুর পরিমাণে কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্স ভ্যাকসিন রপ্তানি করবে। ভারতের ভ্যাক্সিন পাঠানো হচ্ছে সরকারি ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানি এইচএলএল লাইফকেয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে।
ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতের বিশ্লেষকরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদকে। আমেরিকা ও ইউরোপের মতো ডেভেলপড রাষ্ট্রসমূহের অর্থের কোন সমস্যা নেই। তারা আগেই বিভিন্ন উৎপাদনকারীদের সাথে ভ্যাকসিন এর জন্য চুক্তি সই করে ফেলেছে। ফলে সেই সমস্ত দেশগুলোর ন্যাশনালিজম মারাত্মক আকারে ফুটে উঠত। কিন্তু ভারত তা হতে দেয়নি। তারা তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জারি রেখে স্বল্প মূল্যে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে ভ্যাকসিন রপ্তানির চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্বল্প কিন্তু ধনী বাজারের চাইতে অপেক্ষাকৃত কম ধনী বৃহৎ বাজারের দিকে নজর ভারতের। মহামারীতে বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত তখন ভারত অন্তত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে যত ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয় এর ৬০% ভ্যাকসিন ভারত একাই উৎপাদন করে। উন্নত রাষ্ট্র সমূহে করোনা ভাইরাস নিয়ে তারা নিজেরা বেশ বিপর্যস্ত। সমগ্র বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু উন্নত দেশগুলোতেই। ফলে তাদের হাত দিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে ভ্যাকসিন পৌঁছাবে এই ভাবনাটা অলৌকিক। তাছাড়া তাদের নিজেদের বানানো ভ্যাকসিন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর জন্য ব্যয়বহুল হবে। সেক্ষেত্রে ভারতই ছিল এখানে গরীবের শেষ ভরসার স্থল। এই সুযোগের পূর্ণ সুবিধা ভারত নিয়েছে। ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর জরুরি ভ্যাকসিন চাহিদা পূর্ন করতে এগিয়ে আসা তারা।
জুলাইয়ের মধ্যে নিজ দেশেই তারা ৩০০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন প্রয়োগের টার্গেট নিয়েছে। এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে ভ্যাকসিন প্রদান করে দীর্ঘ মেয়াদী সু-সম্পর্ক তারা গড়ে তুলবে। চীনের সাথে ভারতের বর্তমানে যে দ্বন্দ্ব চলছে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি ভারতকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া চীনের ভ্যাকসিন বহু রাষ্ট্র গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর মূল কারণ হ’ল চীনা ভ্যাকসিন ততটা স্বচ্ছ না। ভারতের ভ্যাকসিন মানব শরীরে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী হলেও এটি এমনকি যদি গ্রহণযোগ্যতা নাও পায় তবুও এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ভারতের সুনাম অর্জনের এই মিশন কতটা সফল হবে এটা শুধু সময়ই বলে দিবে।
আপনার মতামত জানানঃ