পরিবেশ, অভিযোজন ক্ষমতা মানুষের শরীরে নতুন অবয়ব দেয়। মিলিয়ন বছর পর কেমন হবে সেই অবয়ব বিবিসি আর্থ অবলম্বনে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মানুষ বেঁচে থাকলে বদলায়’। তার কথার সূত্র ধরে যদি ভাবি মিলিয়ন বছর পর মানুষ শারীরিকভাবে কতটা বদলাবে? বিজ্ঞান বলছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে অভিযোজন করতে গিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের মানসিক পরিস্থিতি ও শারীরিক বিবর্তন ঘটাচ্ছে। মিলিয়ন বছর আগে আজকের যে মানুষ, তারা এমন ছিল না। ধীরে ধীরে তার শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটেছে। আগামী সহস্র বছরেও যে পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে। আগে যেমন মানুষ বুনো পরিবেশে বাস করত, এখন তা বদলে গেছে। তখন যে শারীরিক কাঠামো ছিল, সেটিও আর নেই। একইভাবে ভবিষ্যতের পৃথিবীতেও মানুষ শারীরিকভাবে এখন যেমন আছে, তখন তেমন থাকবে না। মানসিক বদলও ঘটে যাবে নিশ্চিত।
এখন যেমন মানুষের অনেক ধরনের শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে ওষুধসহ নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবহার হচ্ছে। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্র মানুষ নিজের বসবাসের স্বপ্ন দেখছে। সে লক্ষ্যে কাজও করছে। ভাবা হচ্ছে যে মানুষ মহাশূন্যেও বসবাস শুরু করবে। মঙ্গলগ্রহে গিয়ে বংশবিস্তার করবে। তখন মানুষকে কেমন দেখাবে? ভবিষ্যৎ মানুষ কী শরীরে উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্র নিয়ে ঘুরবে, রক্ত-মাংসের হাত-পা-ফুসফুস প্রতিস্থাপিত হবে কোনো কৃত্রিম অঙ্গ দিয়ে? চোখে বসানো হবে ক্যামেরা। কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের মতো মানুষ হয়ে উঠবে সাইবর্গ?
এ বিষয়ে বিবিসি আর্থ প্রকাশ করেছে প্রতিবেদন। সেখানে আলোচনা হয়েছে, মানুষ কি জৈবিক এবং কৃত্রিম প্রাণীর একটি মিশ্র প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে পারে? এক মিলিয়ন বছর পর সৃষ্টির সেরা এ জীব কি আরও খাটো হবে না লম্বা, পাতলা না মোটা হয়ে যাবে? এমনকি মুখের আদল আর ত্বকের রঙের ক্ষেত্রেই বা কী ঘটতে পারে?
বিবিসি আর্থ ডটকম-এ নিবন্ধটি লিখেছেন বিজ্ঞান লেখক লুসি জোনস। তিনি বলছেন, মানুষ মিলিয়ন বছর পর দেখতে কেমন হবে সে বিষয়ে আমরা এখনই কিছু জানি না। তবে এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার জন্য মানুষ আগে দেখতে কেমন ছিল তা জানা যাক। এক মিলিয়ন বছর পেছনে ফিরে দেখা যাক। লুসি বলছেন, এখন যে মানুষকে দেখা যাচ্ছে শুরুতে সেই হোমো সেপিয়েন্সের অস্তিত্ব ছিল না। এক মিলিয়ন বছর আগে মানুষ দেখতে এমন ছিল না। গত ১০ হাজার বছরে অভিযোজনের ফলে মানুষের শরীরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে আমরা এখন বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছি, যেমন ইনসুলিন দিয়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হচ্ছে। চেহারার দিক থেকে মানুষ আগের চেয়ে মোটা এবং কিছু ক্ষেত্রে লম্বাও হয়েছে। লন্ডনের অ্যাংলিয়া রাস্কিন ইউনিভার্সিটির বায়োইনফরমেটিক্স-এর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক টমাস মাইলুন্ড অনুমান করেন, সম্ভবত তারপর আমরা খাটো হতে থাকব। কারণ পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতে আমাদের গ্রহ উচ্চ জনবহুল হয়ে উঠবে। তখন দেহ কম শক্তি আহরণের জন্য অভিযোজিত হবে। ফলে উচ্চতা এখনকার চেয়ে কমে আসবে।
মাইলুন্ড বুঝাতে চাইছেন, কম ঘনত্বে প্রচুর মানুষের সঙ্গে বসবাসের নতুন অবস্থার সঙ্গে তখন মানিয়ে নিতে হবে। আমরা যখন শিকারি, সংগ্রহকারী ছিলাম; তখন দিনে নিয়ম করে আমাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া হতো। কিন্তু যখন উচ্চ ঘনত্বে বসবাস করব, তখন এমন কিছু দক্ষতা বিকশিত হবে যা ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তা করবে। তখন ঘন ঘন একের সঙ্গে অন্যের দেখা হয়ে যাবে। ফলে তখন উদাহরণস্বরূপ মানুষের নাম মনে রাখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হয়ে উঠতে পারে। আর এখানেই প্রয়োজন হবে প্রযুক্তির। ‘মস্তিষ্কে একটি ইমপ্লান্ট বসানো হবে যা মানুষের নাম মনে রাখার অনুমতি দেবে’। মাইলুন্ড আরও বলছেন, আমরা জানি যে মস্তিষ্কের কোন জিনগুলো মানুষের নাম মনে রাখতে পারে। যদিও এটা কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু আমরা এখনই তা করতে পারি। আমরা এটাকে ইমপ্লান্ট করতে পারি। কিন্তু আমরা এখনো জানি না কীভাবে এটা কাজে লাগবে, কতটা উপকারে আসবে। আমরা খুবই পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছি।
সাইবর্গ একটি কাল্পনিক ধারণা হিসেবে এখনো অনেকে মনে করলেও, এর বাস্তব প্রমাণ রয়েছে কিছু কিছু। সাইবর্গ হলো এমন এক ব্যক্তি যার নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় কার্যকারিতা একটি যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। লুসি জোনস বলছেন ভবিষ্যতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। তিনি লিখেছেন, বর্তমানে মানুষ তার কোনো অঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে সেগুলো প্রতিস্থাপন করে। যেমন পেসমেকার বা হিপ ইমপ্লান্ট। কিন্তু ভবিষ্যতে যা করা হবে তা হলো কোনো ব্যক্তির শারীরিক যোগ্যতা বাড়াতে ইমপ্লান্ট করা হবে। তখন মস্তিষ্কের ইমপ্লান্টের পাশাপাশি, চোখে বসানো হতে পারে এমন এক ক্যামেরা বা কৃত্রিম চোখ যা অনেক অদৃশ্য রঙ এবং এর মাত্রাগুলো দেখতে পারবে। এমনকি এ পরিবর্তনও আসতে পারে যে মা-বাবা কেমন সন্তান চান তার জিনগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ভ্রুণে আরোপ করা হতে পারে। যদিও এগুলো নিষিদ্ধ। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কী ঘটবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বাস্তুসংস্থানবিদ এবং পরিবেশবিদ ড. জেসন এ. হজসন বলেন, এক মিলিয়ন বছর পর মানুষ দেখতে কেমন হবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। তবে অদূর ভবিষ্যতে এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা অনেকটা সম্ভব হবে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করে।
লুসি বলছেন, এখন আমাদের কাছে বিশ্ব জুড়ে মানুষের সম্পূর্ণ জিনোমের জেনেটিক নমুনা রয়েছে। জেনেটিকবিদরা জেনেটিক বৈচিত্র্য এবং এটি কীভাবে জনসংখ্যার মধ্যে গঠিত হয় সে সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাচ্ছেন। জেনেটিক প্রকরণ কীভাবে পরিবর্তিত হবে তা আমরা ঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না, তবে বায়োইনফরমেটিক্স বিজ্ঞানীরা আমাদের কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
হজসন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, শহুরে এবং গ্রামীণ অঞ্চলগুলোর জিনগতভাবে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য দেখা দেবে। সাধারণত অভিবাসন গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে আসে। তাই শহরে জেনেটিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় হ্রাস পাবে। এটি বিশ্ব জুড়ে পরিবর্তিত হবে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্যে গ্রামীণ এলাকার জিনে কম বৈচিত্র্য থাকবে। কারণ সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাস করার ঐতিহ্য আছে। কিন্তু শহর এলাকায় অভিবাসীদের কারণে জিনগত বৈশিষ্ট্যে বৈচিত্র্য থাকে।
আবার কিছু গোষ্ঠী বেশি বা কম হারে প্রজনন করছে। যেমন আফ্রিকার জনসংখ্যা দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তাই তাদের জিনগুলো বিশ্বব্যাপী উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে বৃদ্ধি পায়। তবে যাদের ত্বকের রঙ হালকা, তারা কম প্রজনন করছে। হজসন ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী মানুষের ত্বকের রঙ আরও গাঢ় হবে। তিনি বলেন, এটি প্রায় নিশ্চিত যে গাঢ় ত্বকের রঙ হালকা ত্বকের রঙের তুলনায় বৈশ্বিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি আশা করি যে এখন থেকে বেশ কয়েক প্রজন্মের গড় মানুষের ত্বকের রঙ এখনকার চেয়ে গাঢ় হবে।
মানুষের স্বপ্ন আছে মহাশূন্যে বসবাসের। লুসি যে কারণে এরপর আলাপ তুলেছেন স্থান নিয়ে। তিনি বলছেন, মানুষ যদি মঙ্গলগ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করে, তাহলে দেখতে কেমন হবে? সেখানে কম মাধ্যাকর্ষণের কারণে আমাদের শরীরের পেশির গঠনে পরিবর্তন আসতে পারে। সম্ভবত আমাদের হাত এবং পা আরও লম্বা হতে থাকবে। শীতল, বরফ যুগের মতো জলবায়ুতে কী ঘটতে পারে? আমরা কি নিয়ান্ডারথালদের মতো আরও ভারী হব এবং শরীরের চুলের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে? আমরা জানি না, তবে অবশ্যই মানুষের জিনগত পরিবর্তন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মানুষের জিনোমে তিন দশমিক পাঁচ বিলিয়ন জোড়ার প্রত্যেকটির মধ্যে মোটামুটি দুটি নতুন মিউটেশন ঘটছে। যা বেশ আশ্চর্যজনক এবং এর ফলে বোঝা কষ্টকর যে আমরা এক মিলিয়ন বছরে দেখতে কী রকম হব!
মিলিয়ন বছর পর মানুষ দেখতে কেমন হবে, এ নিয়ে কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। তবে তখনকার চেহারা-সুরত এখনই অনুমান করা কষ্টকর। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ, জিনগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে বিভিন্ন অনুমান সামনে নিয়ে আসছেন। তবে পশ্চিমা বিশ্বে প্রযুক্তি-নির্ভরতা চিন্তার ক্ষেত্রকে একটি আকার দিচ্ছে।
যে কারণে তাদের অনুমানের ভিত্তি হয়ে উঠছে প্রযুক্তি। এশিয়ায়ও চীন প্রযুক্তিগত দক্ষতা অনেকটা বাড়িয়েছে। তবে বিশ্বের সব দেশের মানুষ সেসব প্রযুক্তির সমান ব্যবহার করতে পারবে না। এর অন্যতম কারণ সেগুলো হবে ব্যয়বহুল। যা মেটানো অসম্ভব অনেকের জন্য। তাদের শারীরিক পরিবর্তন কেমন হবে সেসব নিয়েও গবেষণার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এখানকার উপকূলীয় এলাকার জীবনধারাও বদলে গেছে। অনেকে শহরে এসে উঠছেন। যারা উপকূলেই থেকে যাচ্ছেন তাদের শারীরবৃত্তীয় নানা আচরণ পাল্টাচ্ছে। সে সবের ভিত্তিতে তাদের পরিবর্তন কেমন হবে তা গবেষণা ছাড়া বোঝার উপায় নেই।
লুসি জোনসের আলোচনার সূত্র ধরে বলতে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ যে অবস্থায় আছে তাতে এখানকার স্থলভাগের পরিমাণ কমবে এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়বে। কিছু গবেষণা বলছে, এ সময়ে বাংলাদেশে জন্মহারও কমবে। শারীরিক কিছু পরিবর্তনও আসতে পারে। তবে যদি জলবায়ু বিপর্যয়ের লাগাম ধরে রাখা যায়, তাহলে কষ্ট কম হবে বিশ্ববাসীর।
আপনার মতামত জানানঃ