চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে তুলে ধরত ভারত। কিন্তু গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকে দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে এবং দৃশ্যমান হচ্ছে সখ্যতা।
ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে গিয়ে বাজিমাত করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা ছাড়বেন) ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশে সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস।
তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। হোয়াইট হাউসের ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। ডেমোক্রেটদের কাছ থেকে ক্ষমতা চলে গেছে রিপাবলিকানদের হাতে। গত ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। মসনদে আসীন হওয়ার পর চার বছর হোয়াইট হাউসের দেখভাল করবেন তিনি।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট বোদ্ধামহল মনে করছে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি কাজ করার ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে, বাংলাদেশ ইস্যুতে মোটাদাগে আমূল পরিবর্তন আনবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
৫ আগস্টের পর দিল্লির সঙ্গে টানাপোড়েন নিরসনের প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি ইতিবাচক দিক। ওই বৈঠকের সুফল আসবে কি না, সেটি বোঝা যাবে আরও পরে। কোনো কারণে যদি ইতিবাচক কিছু নাও হয়, অন্তত দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে; হয়ত রাজনৈতিক দূরত্ব থাকবে
এ ছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ধীর চলো’ নীতিতে সামনে এগোচ্ছে। সেজন্য বেইজিং বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার গঠনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা বিএনপি-জামায়েতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন কমাতে চলতি মাসে ঢাকায় বৈঠকে বসেছিলেন দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবরা। টানাপোড়েন আর আস্থার সংকট কাটাতে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ঐকমত্য হয়েছেন। তবে, বিজয় দিবসের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিতর্কিত পোস্ট ভালোভাবে নেয়নি ঢাকা। এটি ঢাকা-দিল্লির রাজনৈতিক সম্পর্কের জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের বার্তা দিচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ৫ আগস্টের পর দিল্লির সঙ্গে টানাপোড়েন নিরসনের প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি ইতিবাচক দিক। ওই বৈঠকের সুফল আসবে কি না, সেটি বোঝা যাবে আরও পরে। কোনো কারণে যদি ইতিবাচক কিছু নাও হয়, অন্তত দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে; হয়ত রাজনৈতিক দূরত্ব থাকবে।
এদিকে, দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হলেও ইসলামাবাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূস বিদেশের মাটিতে ইতোমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেছেন। সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে প্রথম বৈঠকে মিলিত হন ইউনূস-শেহবাজ। তিন মাসের মাথায় ফের ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে (১৯ ডিসেম্বর) মিসরের রাজধানী কায়রোতে বৈঠকে বসেন তারা।
এ ছাড়া পাকিস্তানের হাইকমিশনার ঢাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, ইসলামাবাদের কোনো হাইকমিশনার বর্তমানে ঢাকায় সেরা সময় পার করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে প্রথম বিদেশ সফর শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় সফরে নভেম্বরে আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে মিসর সফর করেন। তিনটি সফরই বহুপাক্ষিক।
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। এমন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন কোনো নজির নেই। ওই সফরে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সাইডলাইনে ৪০টি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন।
ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। ড. ইউনূসের নিউইয়র্ক সফরে সেই সংকট অনেকটা কেটেছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি সংকট ছিল, সেটা কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে গত অক্টোবরে ঢাকা সফর করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফরের তিন মাসের মাথায় সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেন পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা।
প্রায় ১১ বছর পর মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। এটি ছিল অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকায় কোনো দেশের শীর্ষ নেতার প্রথম সফর। ওই সফরে প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশিকর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস দেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
অন্যদিকে, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোর্তার ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি সই হয়েছে।
নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার নিয়োগ ও রদবদল প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে শূন্য পদে নিয়োগ ও রদবদল মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে চলেছে।
এখন পর্যন্ত দুটি মিশনে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ওআইসিতে (ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) স্থায়ী প্রতিনিধি প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া লন্ডন, রোমানিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পর্তুগাল মিশনের জন্য শিগগিরই নিয়োগপ্রাপ্ত দূতদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেবে সরকার।
আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের মধ্যে অন্যান্য মিশনেও দূত নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হবে। কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত কম সময়ে এত বেশি মিশনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ বা রদবদলের ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে একসঙ্গে এত মিশনে দূত নিয়োগ বা রদবদলের ঘটনা ঘটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা কূটনৈতিক অঙ্গনে বড় পরিবর্তন।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে ঝামেলায় আছে বাংলাদেশ। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে না পারার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে চলমান অস্থিরতা এবং নতুন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশের।
নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়ে নীতিগতভাবে পক্ষে নয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে বাড়তি ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ২৭০ কিলোমিটার এলাকা দখল নিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা আরাকান আর্মি। এছাড়া, দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মংডুর সেনা ঘাঁটি দখলে নিয়ে ১৬৮ মাইল এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ডমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যে শুধু দুবাইয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ১৮৮ প্রবাসী কর্মী মুক্তি পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই দেশে ফিরে এসেছেন।
ড. ইউনূসের দায়িত্বগ্রহণের পর প্রবাসীদের দণ্ডমুক্ত করা অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, ইতালির ভিসা প্রার্থীদের নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে সরকার। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশকিছু দেশে বাংলাদেশিকর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে কর্মীরা কাজ না পেয়ে বিপাকে আছেন।
এদিকে, লেবাননে যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৪২ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরানো হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বাংলাদেশি নাগরিকদের গুমের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল। তবে, সেটি সেই অর্থে আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২৯ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ঢাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. ইউনূস এ সনদে স্বাক্ষর করেন।
আইসিপিপিইডি জাতিসংঘের অধীন একমাত্র আন্তর্জাতিক কনভেনশন যা এনফোর্সড ডিসএপিয়ান্স-কে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছে। যার লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম প্রতিরোধ করা, ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া গুরুতর এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
আপনার মতামত জানানঃ