সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, চিকিৎসার নামে প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ (প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) বিদেশে চলে যায়। প্রতিবছর এত বিশাল পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে যাওয়া আমাদের মতো দেশের অর্থনীতির ওপর বিশাল একটা চাপ।
দেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সময় এসেছে বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনার। পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়া এবং সেখানকার কিছু হাসপাতাল বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা না করার ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টিকে সম্ভাবনা হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে বছরে প্রায় ৫ লাখ লোক যান, এর ৮০ শতাংশই যান ভারতে। এই যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, এর সিংহভাগই যায় অবৈধভাবে, হুন্ডির মাধ্যমে।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী? দেশের স্বাস্থ্যসেবার ৬০ শতাংশই বেসরকারি খাত থেকে আসে। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর তিন ভাগের দুই ভাগই বেসরকারি পর্যায়ের। আর যাঁরা দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান, তাঁরাও যখন দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসাসেবা নেন, তখন তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ওপরই নির্ভর করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যাঁরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, তাঁদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের মতো প্রয়োজনীয় সক্ষমতা আমাদের আছে কি? পরিসংখ্যানগত হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের মতো রোগী বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। আর দেশে বেসরকারি পর্যায়ে শয্যাসংখ্যা রয়েছে প্রায় এক লাখ। এর মধ্যে টারশিয়ারি পর্যায়ের জন্য আছে ২০ হাজার। তাই বলতে হয়, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, শয্যাসংখ্যা যা আছে, সেটা ভারতগামী রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত।
রোগীরা বিদেশে যান প্রথমত বিশেষায়িত চিকিৎসক, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যথাযথ ডায়াগনসিসের জন্য। বর্তমানে বাংলাদেশে বিশেষায়িত দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক আছে, গুণগত মানের দিকে দিয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহে ভারতের চিকিৎসকদের সমকক্ষ। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানও বিশ্বমানের। ল্যাবএইড, পপুলার, ইবনে সিনাসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেখান থেকে টেস্ট করিয়ে নিয়ে গেলে ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা গ্রহণ করেন। আবার নতুন করে টেস্ট করতে বলেন না।
এবার রোগের প্রসঙ্গে আসি। হৃদ্রোগ, ক্যানসার, কিডনি, নিউরো, অর্থোপেডিক চিকিৎসার জন্যই লোকজন সাধারণত বিদেশে যান। হৃদ্রোগের সব ধরনের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশেই হয়ে থাকে। ক্যানসারের জন্য দেশে রয়েছে বেশ কয়েকটি সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র; এর মধ্যে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল, আহ্ছানিয়া ক্যানসার হাসপাতাল উল্লেখযোগ্য।
এসব হাসপাতালে টিউমার বোর্ড, বিশেষায়িত পরীক্ষা, কেমোথেরাপি, সার্জারি, রেডিওথেরাপিসহ ফলোআপের যেসব প্রযুক্তি রয়েছে, তা উন্নত বিশ্বের মতোই। তারপর কিডনি, অর্থোপেডিক, নিউরোবিষয়ক যে চিকিৎসা এখানে হচ্ছে, তার মান ভারতের হাসপাতালের মতোই। কিন্তু এটাও সত্য যে অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেনশনে আমরা একটু পিছিয়ে আছি। এর মূল কারণ আমাদের মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা আর নিয়মনীতির বাধা।
খরচের বিষয়ে আসি। রোগীরা দেশের বাইরে গিয়ে টাকা খরচ করেই চিকিৎসা নেন। তাই দেশে বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় তাঁরা সহজেই বহন করতে পারেন। ভারতের ভালো সেন্টার, যেমন ম্যাক্স, ফর্টিস, অ্যাপোলো হাসপাতালের খরচ আমাদের বেসরকারি হাসপাতালের খরচের তুলনায় ২ থেকে ৩ গুণ। থাইল্যান্ডের খরচ ৬ থেকে ৭ গুণ আর সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা খরচ প্রায় ১০ গুণ। এ ছাড়া সঙ্গে লোক যাওয়া, থাকা, ফলোআপের জন্য আবার যাওয়া—এসব মিলে খরচের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। সে তুলনায় দেশে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় অনেক কমের মধ্যেই হয়; যদিও দৈনন্দিন খরচে স্বাস্থ্যের জন্য কোনো বরাদ্দ না থাকায় এ ব্যয় প্রায়ই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বহুল আলোচিত একটা বিষয়ে আসি। দেশের চিকিৎসক, হাসপাতাল তথা চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কম থাকার পেছনে কিছু কারণের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। চিকিৎসকদের ব্যবহার, রোগীকে চিকিৎসকদের কম সময় দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা, কমিশন—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। হাজারটা সফল চিকিৎসার পর একটা অসফল বা ভুল–বোঝাবুঝি মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয় বেশি।
আবার বিপরীত দিকে আমাদের অনেক ইতিবাচক ঘটনাও আছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সময়ে কোভিডের কারণে কোনো রোগী চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারেননি। আমরাই চিকিৎসা দিয়েছি এবং সেটি সাফল্যের সঙ্গেই।
সরকার পরিবর্তনের পর এ বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে অনেকেই ভিসাসহ বেশ কিছু জটিলতার কারণে ভারতে যেতে পারেননি। এই চার মাসে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা আমরা দিয়েছি। এখনো দিচ্ছি। ভারতে যেতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা গেছেন—এমন সংবাদও কিন্তু আমরা পাইনি।
তাই আমরা মনে করি, এখনই সময়। আমাদের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল, পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন খুবই দরকার। চিকিৎসকদের উচিত হবে রোগীদের আরও আন্তরিকতার সঙ্গে দেখা, আরও বেশি সময় দেওয়া। হাসপাতালের কাউন্সেলিং পার্ট বাড়াতে হবে; পাশাপাশি রোগীদের কাছ থেকেও আমরা প্রত্যাশা করি, দেশের চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর তাঁরা আস্থা রাখবেন।
আরেকটা জরুরি বিষয়, আমাদের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব তহবিল থাকা দরকার। মাসের খরচের ৫ থেকে ৬ শতাংশ আমরা যদি চিকিৎসার জন্য জমিয়ে রাখি, তাহলে হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা বা চিকিৎসার জন্য আর বিপাকে পড়তে হবে না। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকেও সতর্ক থাকতে হবে চিকিৎসাবিষয়ক ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে। বিপরীত দিকে চিকিৎসকদেরও উচিত হবে রোগীর যত্ন আরও বাড়িয়ে সেবার মান উন্নত করা। বিষয়টি এমন যুগপৎভাবে ঘটলে তাহলেই আমাদের চিকিৎসাসেবার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।
একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থার চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম নই বললে অত্যুক্তি হবে না। ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা আর নয়। আসুন, সবাই মিলে আমরা দেশকে ভালোবাসি। যাঁরা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁদের নিজের আত্মীয়র মতো আপন করে নিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় স্বনির্ভর একটা বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
আপনার মতামত জানানঃ