কুয়াকাটা সৈকতের কোল ঘেঁষে রয়েছে বিশাল বনাঞ্চল। একসময় কুয়াকাটার সৈকত ঘেঁষা নারকেল বাগান, জাতীয় উদ্যানের ঝাউ বাগান, ম্যানগ্রোভ বন পর্যটকদের আকৃষ্ট করতো। কিন্তু সেই বনভূমি ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে। বনের গাছ কেটে সেখানে বসতি স্থাপন করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দেদারছে সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে বনের জমিতে বাড়ি-ঘর তুলছে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ। বন বিভাগ চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। সম্প্রতি দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে তারা।
জানা যায়, দখলদাররা ইতোমধ্যে ৩২৯.৬০ একর বনভূমি দখল করে ফেলেছে। তবে তাদের মধ্যে ৩৮৩ জনকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে বন বিভাগ।
পটুয়াখালী বন বিভাগ কার্যালয় জানায়, কুয়াকাটায় বনের আয়তন ৪ হাজার ২৮৪ দশমিক ৯৩ একর। এর মধ্যে লতাচাপলি মৌজায় এক হাজার ৮১৮ দশমিক ৯৩ একর ও গঙ্গামতি মৌজায় ২ হাজার ৪৬৬ একর। ২০০৫ সালে সরকার কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। কুয়াকাটাকে পর্যটকদের কাছ আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে প্রতিবছরই প্রাকৃতিক বন সংলগ্ন বাগান গড়ছে বন বিভাগ। কিন্তু সেই বাগান ধ্বংস করে দখলদাররা বনভূমির ৩২৯ দশমিক ৬০ একর জবরদখল করেছে। এর মধ্যে লতাচাপলি মৌজায় ২১৩ দশমিক ১৫ একর ও গঙ্গামতি মৌজায় ১১৬ দশমিক ৪৫ একরসহ মোট ৩২৯ দশমিক ৬০ একর বনভূমি জবরদখল হয়েছে।
বন বিভাগ কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯ অক্টোবর সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে সভায় বেদখল হওয়া বনভূমির বর্তমান অবস্থা কী, বনভূমি দখলদারদের তালিকা চেয়েছে। দখলদারদের উচ্ছেদে কী কী পদক্ষেপ নেওয়ো হয়েছে, বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও বনবিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং সংসদীয় কমিটি জরুরী ভিত্তিকে বেদখল হওয়া বনভূমি উদ্ধারে কাজ করবে বলেও জানানো হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা পাওয়ার পর পটুয়াখালী বন বিভাগ জেলা প্রশাসকের কাছে সংরক্ষিত বন ভূমির অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, লতাচাপলি ও গঙ্গামতি মৌজার সংরক্ষিত বনভূমি অবৈধ জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে দখলদারদের নামের তালিকা স্কেচম্যাপসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তার পাঠানো হয়েছে। জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রশাসন হতে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা বন বিভাগের জানা নেই। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১৬ তম সভায় বন বিভাগের নামে রেকর্ডীয় ভূমি, জবরদখল ও জবরদখল উচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়ে অগ্রগতি সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য প্রেরণ করার জন্য জরুরী তাগিদ রয়েছে। এই অবস্থায় জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় ওই চিঠিতে।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দখলদাররা গঙ্গামতি মৌজার বন বিভাগের জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটকের সামনে সংরক্ষিত বনের গাছপালা কেটে সেখানে বসতঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন। অনেকে পাকা স্থাপনা উঠিয়েছেন। সৈকতে লবণ পানি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে দখলদাররা শ্যালো নলকূপ বসিয়ে নিয়েছে। বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে অধিকাংশই জেলে। তবে প্রভাবশালীও রয়েছেন। আবার কিছু লোক রয়েছে যারা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে এখানে ভূমি দখলে নিয়ে বসবাস করছেন।
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো.আবুল কালাম আজাদ জানায়, দখলদাররা অনেক প্রভাবশালী। জোর করে বনভূমি নষ্ট করে ঘরবাড়ি তুলে জমি দখল করছেন। বন কর্মীরা বাঁধা দেয়ায় তাদের ওপর হামলা চালিয়ে আহত করা হচ্ছে। এ নিয়ে মহিপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। বনভূমি উদ্ধারে তারা দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পটুয়াখালী কার্যালয়ে পাঠিয়েছে।
পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম জানায়, দখলদারকারীদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও গত ৭ ডিসেম্বর বনভূমি জবরদখলের চাহিদা তথ্যাদি বরিশাল কোস্টাল সার্কেলের বন সরক্ষণ এর মাধ্যমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বরাবর পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলমান রয়েছে। বন বিভাগের প্রস্তাবনায় কুয়াকাটায়ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে এভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ এটাও যে এইভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; অবশ্য এই হিসাব সরকারের বন অধিদপ্তরের। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ এর চেয়ে কম।
বনভূমি জবরদখল ও গাছপালা কেটে উজাড় করার প্রক্রিয়াটি চলছে নিরন্তরভাবে, বছরের পর বছর ধরে। ফরেস্ট ওয়াচ নামের এক আন্তর্জাতিক সংস্থার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো, বনভূমি উজাড় করার এই প্রবণতা কয়েক বছর ধরে ভীষণভাবে বেড়েছে। ফরেস্ট ওয়াচ বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরেই উজাড় হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার একর বনভূমি। অর্থাৎ ২০১৪ সালের আগ-পর্যন্ত ১৩ বছরে যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়েছে, তার প্রায় দ্বিগুণ উজাড় হয়েছে সর্বশেষ পাঁচ বছরে। ২০১৮ সালের পরের দুই বছরে হিসাব পাওয়া যায়নি; কিন্তু ধারণা করা যায়, ওই একই হারে বনভূমি উজাড় চলতে থাকলে দেশের বনভূমির পরিমাণ আরও অনেক কমে যাবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধ দখলদারেরা সাধারণত স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে থাকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে না। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের দমন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বন বিভাগের অসাধু অংশের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশও ছিন্ন করতে হবে। আর অবিলম্বে বেদখলে থাকা বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৬
আপনার মতামত জানানঃ