প্রক্রিয়াটি প্রতিদিন রাতে শুরু হয়। আলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির ওপরে ভাসমান শত শত কোটি জুপ্ল্যাঙ্কটন, কাঁকড়াজাতীয় প্রাণী বা ক্রাস্টেসিয়ান এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীব অতি ক্ষুদ্র শৈবাল খাওয়ার জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসে।
এরপর সূর্যোদয়ের সময় তারা আবার সমুদ্রের গভীরতায় ফিরে যায়। তবে এই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অভিবাসন ঘটে প্রাণীর। সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছর বায়ুমণ্ডল থেকে লাখ লাখ টন কার্বন অপসারণ করে এসব সামুদ্রিক প্রাণী।
জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাজার হাজার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে এই কার্যকলাপও একটি। সামগ্রিকভাবে এই প্রক্রিয়াটি বিশ্বের মহাসাগর, বন, মাটি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক কার্বন বেসিন সমস্ত মানব নির্গমনের প্রায় অর্ধেকই শোষণ করে। তবে পৃথিবী উত্তপ্ত হওয়ায় বিজ্ঞানীরা ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা উষ্ণতম বছর ২০২৩ সালে তা অভিনব আকারে হাজির হয়েছে। বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দলের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমির কার্বন শোষণের পরিমাণ সাময়িকভাবে ধসে পড়েছে। গত বছর বিশ্বের বন, গাছপালা এবং মাটি কার্যত কোনো কার্বন শোষণ করেনি। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, কার্বন নির্গমনের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে যেতে পারে।
আমাদের গ্রহটি ঐতিহাসিকভাবে প্রাকৃতিক ‘কার্বন সিঙ্ক (বেসিন)’ বা বন এবং মহাসাগর আবাসস্থল। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে সম্ভাব্য ক্ষতিকারক কার্বন ডাইঅক্সাইড সরিয়ে দেয়। ফলে কার্বন সিঙ্কের আকস্মিক পতন বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। ২০২৩ সালে উত্তর গোলার্ধ্বে ভয়াবহ দাবানল ভূমি বেসিনের কারণে ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
গার্ডিয়ান বলছে, জুপ্ল্যাঙ্কটনের ওপর ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ায় কার্বন শোষণের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মানবজাতির অপ্রতিরোধ্য নির্ভরতা প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্কের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে।
পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের গবেষক জোহান রকস্ট্রোম গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘চাপে থাকা গ্রহ আমাদের নীরবে সাহায্য করছে। তবে আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি। ফলে আমরা সত্যিই সংকট দেখতে পারছি না।’
ইংল্যান্ডের এক্সেটার ইউনিভার্সিটির সামুদ্রিক এবং বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞান গ্রুপের পরিচালক অ্যান্ড্রু ওয়াটসন গার্ডিয়ানকে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে ভূমি এবং সমুদ্রের উভয় বেসিনই হ্রাস পেতে চলেছে। তবে এটি কত দ্রুত ঘটবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে পৌঁছতে এক দশক বা এক শতাব্দী সময় লাগুক না কেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কার্বন সিঙ্কের পতনে একটি ভয়ংকর লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা শিগগির ত্বরান্বিত হতে পারে।
পটসডাম ইনস্টিটিউটের জোহান রকস্ট্রম গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জলবায়ু সপ্তাহের এক অনুষ্ঠান বলেছেন, ‘আমরা পৃথিবীর ব্যবস্থাপনায় স্থিতিস্থাপকতার ফাটল দেখছি। আমরা ভূমিতে ব্যাপক ফাটল দেখতে পাচ্ছি যাতে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র তাদের কার্বন সঞ্চয় এবং কার্বন গ্রহণের ক্ষমতা হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, মহাসাগরগুলোও অস্থিতিশীলতার লক্ষণ প্রকাশ করছে।
তিনি বলেন, প্রকৃতি এখন পর্যন্ত আমাদের অপব্যবহারের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। তবে এটি শেষ হতে চলেছে।
মহাসাগরের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম সক্রিয় কার্বন নির্গমনকারী মাটি। বর্তমান হারে চলতে থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ তা ৪০% বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক সিঙ্কগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিলে কী হবে– বিজ্ঞানীরা তারও জবাব দিয়েছেন। তাদের মতে, জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার পরিণতি নির্মম হতে পারে। এমনকি প্রাকৃতির কার্বন শোষণের ক্ষমতার সামান্যতম দুর্বলতার অর্থ হলো শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্বকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আরও ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ