কসমোলজিস্ট মনে করতেন, এটা আসলে এ প্রশ্নটা আসলে উত্তর মেরু বিভ্রমের মতো। উত্তর মেরুতে গিয়ে আরো উত্তরে যাওয়ার চেষ্টা আসলে বৃথা।
১৯২০-এর দশকে যখন মহাবিশ্বের কাঠামো নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন এর পুরোটাই ছিল জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর দাঁড়িয়ে।
অবশ্য কোয়ান্টাম বল্যবিদ্যায় সাহায্য করেছে। অর্থাৎ জৌাতিকণাপদার্থবিদ্যা দিয়ে মহাবিশ্ব, নক্ষত্রের জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা হতো। এখানে জেনারেল রিলেটিভিটির ছিল মূল ভূমিকা, সহায়ক ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতা বা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাই যদি পদার্থবিজ্ঞানের শেষ কথা হতো, তাহলে বিগ ব্যাংকেই সময়ের শুরু হিসেবে ধরা যেত।
কিন্তু অন্য প্রশ্নটা তুলে দেয় স্ট্রিং থিওরি বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও মনে করা হতো বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমেই সময়ের শুরু হয়েছে। এর আগে সময়ের অস্তিত্ব ছিল না।
কারণ, আমাদের ১৩৮০ কোটি বছরের ইতিহাস যদি পিছিয়ে নিতে শুরু করি, তাহলে এর শেষ হবে একটি উত্তপ্ত ঘন বিন্দুতে।
যে বিন্দুতে আসলে পদার্থবিজ্ঞানের সব আইন ভেঙে পড়ে। সেই বিন্দুটাকে বলে সিঙ্গুলারিটি। ১৯৬০-এর দশকে স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ এই সিঙ্গুলারিটির তত্ত্ব দেন। সিঙ্গুলারিটি এমন বিন্দু, যেখানে মহাবিশ্বের সব ভরশক্তি আটকে ছিল, তারপর একসময় প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে বস্তুগুলো আলাদা হয়ে যায়। স্থানকালের জন্ম হয়, জন্ম হয় মহাবিশ্বের।
তারপর দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে মহাবিশ্ব। এমন সিঙ্গুলারিটির ধারণা আছে ব্ল্যাকহোলেও। একটা অতিকায় নক্ষত্র জ্বালানি শেষ করে, হঠাৎ নিজের কেন্দ্রের দিকে ভেঙে পড়ে একসময়। কেন্দ্রের সেই আকার-আয়তনহীন বিন্দুর ভেতর ঢুকে পড়ে নক্ষত্রটির সবটুকু ভর ও শক্তি। সেই বিন্দুটিই হলো ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটি। এই সিঙ্গুলারিটিতেও পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত আইন ভেঙে পড়ে।
বিজ্ঞানীদের কাছে সিঙ্গুলারিটি অস্বস্তিকর বিষয়। যেখানে মহাবিশ্বের কোনো আইনই চলে না, সেখানে আপনার করার কিছুই থাকে না। ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটি এখনো বহালতবিয়তে আছে। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের সময়কার সিঙ্গুলারিটি প্রায় বাতিলের খাতায় পড়ে গেছে। তাই সিঙ্গুলারিটিতেই সময়ের শুরু এ কথা বলতে এখন পদার্থবিজ্ঞানীদের অস্বস্তি লাগার কথা। আর অস্বস্তিটা তৈরি করেছে স্ট্রিং থিওরি।
বর্তমানে ‘থিওরি অব এভরিথিং’ বা সব কিছুর তত্ত্ব হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে স্ট্রিং থিওরি। কণাজগৎ থেকে মহাজগৎ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, কসমোলজি ও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সব সমস্যার সমাধান আছে এই তত্ত্বে। আইনস্টাইনের বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতার ব্যাখ্যা যেমন স্ট্রিং থিওরিতে মেলে, তেমনি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুত আইনের ব্যাখ্যাও দিতে পারে স্ট্রিং তত্ত্ব। তাই পরীক্ষামূলক কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া না গেলেও এই তত্ত্বটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
স্ট্রিং তত্ত্ব বিগ ব্যাংয়ের সিঙ্গুলারিটিকে খারিজ করে দেয়। বরং এই তত্ত্ব বলে, মহাবিশ্বের জন্ম হলো আগের আরেকটি অবস্থার বা ঘটনার ফল। সেই ঘটনা কী—সেটা আমরা এখনো জানি না। কিন্তু সিঙ্গুলারিটির মতো আপনাকে মহাবিশ্বের জন্মের আগের কথা ভাবতে বাধা দেয় না এই তত্ত্ব।
আগে যেমন বলা হতো, বিগ ব্যাংয়ের আগে সময়ের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মানেই হয় না। কিন্তু স্ট্রিং থিওরি আপনাকে সেই নিষিদ্ধ বাউন্ডারি টপকানোর স্বাধীনতা দিচ্ছে।
ইনফ্লেশন বা স্ফীতিতত্ত্বেও মহাবিশ্বের জন্ম আসলে বিগ ব্যাং থেকে। যদিও সিঙ্গুলারিটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাংতত্ত্ব থেকে। কিন্তু সেটাও আসলে বলে মহাবিশ্বের জন্ম শূন্য থেকেই। তাই বিগ ব্যাং থেকেই সময় শুরু ধরা হচ্ছে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। ইনফ্লেশন কিভাবে ঘটেছিল, ইনফ্লেশন ঘটার জন্য এত বিপুল পরিমাণ শক্তির জোগান এলো কোত্থেকে। একটা জবাব আন্দ্রে লিন্ডে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও পরিপূর্ণ ছিল না।
যদি বিগ ব্যাংয়েই সময়ের শুরু না হয়, খানিকটা আগে থেকে যদি মহাবিশ্বের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে মহাবিশ্বের প্রাথমিক বস্তুগুলো (আদতে শক্তি) বিরাট ইনফ্লেশনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে, এবং নিজেদের প্রস্তুত করে নিতে পারবে ইনফ্লেশনের জন্য।
এখন যে প্রশ্নটা এসে যায়, বিগ ব্যাংয়ের আগেও যদি কিছু ঘটে থাকে, সেটা কিভাবে ঘটল? আসলে এ প্রশ্নের ব্যাখ্যার জন্য দরকার ছিল সাধারণ আপেক্ষিতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মেলবন্ধন। অর্থাৎ একটা সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি বা থিওরি অব এভরিথিংসের বড্ড দরকার ছিল। কিন্তু গুথ বা লিন্ডেরা যখন ইনফ্লেশনারিতত্ত্ব দিচ্ছেন, তখন অবশ্য কোয়ান্টাম গ্রাভিটির প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্ব ছিল না।
পরে ওই আশির দশকের মাঝামাঝি গিয়ে দুটি তত্ত্ব হাজির হয়। একটা হলো স্ট্রিং থিওরি, অন্যটা লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি। পরের দুই-তিন দশকে লুপ কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বেশ উন্নতি করেছে। কিন্তু সত্যিকারের কোয়ান্টাম গ্রাভিটি হওয়ার প্রতিযোগিতায় এর চেয়ে বরং ঢের এগিয়ে আছে স্ট্রিং থিওরি।
স্ট্রিং থিওরির সূত্রপাত হয় ইতালিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাবরিয়েল ভেনেজিয়ানো। ১৯৬৮ সালে তিন এই তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন ব্যর্থ হন। কিছুদিনের মধ্যেই তত্ত্বটি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী নতুন করে স্ট্রিং থিওরি আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন। তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর জেনারেল রিলেটিভিটিকে এক সূত্রে গাঁথার কিছু গাণিতিক পথ আবিষ্কার করে এই তত্ত্ব। তার পর থেকেই শুরু হয় এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা।
আপনার মতামত জানানঃ