বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সীমিত রাখতে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সবসময়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা কাজ করে। ২০১৩ সাল থেকে এটা স্পষ্ট। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এতটাই উৎসাহী যে, এই লক্ষ্যে ক্রমাগতভাবে যে কোনো ধরনের রাখ-ঢাক ছাড়াই কথাবার্তা বলা হচ্ছে।
বলেন, ভারত গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে তার উঠান বলে বিবেচনা করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ভারত ভৌগোলিকভাবে তার সীমানা বৃদ্ধি করতে চেয়েছে। তাদের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় ভারত এমন একটা এলাকায় আছে যেখানে তার চারপাশের দেশগুলো তার প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন।
এবার শেখ হাসিনার পালানোর পর থেকেই বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে মাসির দরদ দেখাচ্ছে দেশটি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক ও সে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর ওই কমিটি ২৪ ঘণ্টা নজর রাখবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার এক বিবৃতিতে এই কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে বলেছে, কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশে তাঁদের পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্তাদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিক ও সংখ্যালঘুদের খবর নিয়মিত নেবেন, যাতে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ইন্টার্ন কমান্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণবঙ্গ বিএসএফের ফ্রন্টিয়ার হেড কোয়ার্টার্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল, ত্রিপুরার বিএসএফের ফ্রন্টিয়ার হেড কোয়ার্টার্সের ইন্সপেক্টর জেনারেল, স্থলসীমান্ত অথোরিটির যোজনা ও উন্নয়ন সদস্য এবং ওই সংস্থার সচিব।
ভারতের সরকারি সূত্র বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে সন্ত্রাসীসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ কয়েদি পালিয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আসার চেষ্টা করছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমে খবরে দাবি করা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাংলাদেশ সীমান্তে বহু মানুষ ভারতে আসার জন্য জড়ো হয়েছেন। বিএসএফ ও বিজিবি তাঁদের ফেরত পাঠাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সীমান্তে ভারত নজরদারি জোরদার করেছে। শরণার্থীদের আসা ঠেকাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতের ব্যবসা–বাণিজ্য কী ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সে দেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতের যেসব কোম্পনির বাংলাদেশে বড় ধরনের কার্যক্রম রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, বাংলাদেশের অস্থিরতা ভারতীয় বেশ কিছু কোম্পানির ওপর যে প্রভাব ফেলেছে, তা বোঝা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে তাদের শেয়ারের দামের দিকে তাকালে। বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব কোম্পানির উল্লেখযোগ্য ব্যবসা রয়েছে অথবা বাংলাদেশের বাজারে যাদের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে।
শেখ হাসিনা ভারতের একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র এ কথা উল্লেখ করে ইন্ডিয়া টুডে বলছে, তাঁদের প্রস্থান এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
মারিকো: সাফোলা ভোজ্যতেলের জন্য সুপরিচিত মারিকো। এ ছাড়া শ্যাম্পু, শিশু সুরক্ষাপণ্য ও স্কিন কেয়ার পণ্য বিক্রি করে এই কোম্পানি। মঙ্গলবার ইন্ডিয়া টুডে জানায়, এই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ৪ শতাংশ। কোম্পানিটি তার আয়ের ১১ থেকে ১২ শতাংশ পায় বাংলাদেশ থেকে। তবে মারিকোর আন্তর্জাতিক ব্যবসার ৪৪ শতাংশই বাংলাদেশে বলে জানায় টাইমস অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশের গাজীপুর ও চট্টগ্রামে মারিকোর তিনটি কারখানা রয়েছে। বুধবারে স্টক এক্সচেঞ্জে দেওয়া এক প্রতিবেদনে মারিকো জানিয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে তাদের কার্যক্রম পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তবে তারা চলমান ঘটনার দিকে নজর রাখছে। কোম্পানিটি আরও আশা করছে যে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম দ্রুত শুরু হবে।
পার্ল গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিজ: এটি ভারতের একটি পোশাক তৈরির কোম্পানি। পার্ল গ্লোবাল তার আয়ের ২৫ শতাংশের মতো পায় বাংলাদেশ থেকে। কোম্পানিটি জানায়, তাদের শেয়ারের দাম ৩ শতাংশ কমে গেছে। কারফিউর সময় বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
ইমামি: এই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে ৪ শতাংশ। বাংলাদেশে ইমামির বড় ধরনের উপস্থিতি রয়েছে। অস্থিরতার কারণে এই কোম্পানির কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ইমামি বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করে, যার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত ব্যবহারের পণ্য। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষা পণ্য।
ইন্ডিয়া টুডে বলছে, আরও যেসব কোম্পানির বাংলাদেশে উপস্থিতি রয়েছে এবং ধকল পোহাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বায়ার কর্প, জিসিপিএল, ব্রিটানিয়া, বিকাশ লাইফকেয়ার, ডাবুর, এশিয়ান পেইন্টস, পিডিলাইট, জুবিল্যান্ট ফুডওয়ার্কস ও বাজাজ অটো।
এদিকে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ভারতের এনটিপিসি। তবে ভারতীয় রাষ্ট্রায়াত্ত খাতের এই কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার খুব সামান্য অংশই তারা বাংলাদেশে বিক্রি করে। বাংলাদেশ বড় পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে। আদানির সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করে ইন্ডিয়া টুডে।
২০১৭ সালে করা চুক্তির আওতায় আদানি ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের কাছে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করার কথা। এই প্রকল্প চালু হয় ২০২৩ সালে। তবে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লার দাম নিয়ে এর আগে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্ডিয়া টুডে বলছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চুক্তি সংশোধন করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ