চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে এপ্রিল (১০ মাস) পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রেমিট্যান্স গেছে ১৩ কোটি ৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এর প্রায় ৪০ শতাংশই অর্থাৎ ৫ কোটি ৬ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন ভারতীয়রা। ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের ৪র্থ বৃহৎ উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ। [২৪ জুন ২০২৪, আজকের পত্রিকা]
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়সে ভেলের ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ভারতীয়দের দাপট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় বিভিন্ন খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বেশিরভাগই আসেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। অর্থাৎ সাড়ে ৪ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করছেন। এদের বেতন ডলারে ভারতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়। [৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ডয়েচে ভেলে]
সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের কারণে বাংলাদেশের আইটি সেক্টরে ভারতীয়দের দাপট বেশি। ট্রাভেল এজেন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। পোশাক খাতের টেকনিশিয়ান ও ডিজাইনার কাজে ভারতীয় বেশি। এমনকি সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি, একাউন্টেন্ট, প্রশাসনিক খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার ইউটিউবে প্রচারিত পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার একটি নিউজ-ক্লিপে খবর দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশে নাকি পাঁচ লাখেরও বেশি ভারতীয় কর্মরত রয়েছেন, যার মধ্যে অনুমিত সাড়ে চার লাখই ‘ট্যুরিস্ট ভিসা’ নিয়ে অবৈধভাবে এদেশে কাজ করে চলেছেন। নিউজ-ক্লিপটির হেডলাইন ‘অবশেষে সত্য স্বীকার করলো ভারত বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় হিন্দু কাজ করছে’। ঐ নিউজ-ক্লিপের মতে মাত্র ১০ শতাংশ মানে পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় বাংলাদেশ সরকার থেকে বৈধ ‘ওয়ার্ক পারমিট’ নিয়ে এদেশে চাকুরি করছেন। [১২ আগস্ট ২০২৩, ইনকিলাব]
বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি শ্রমিকের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণের অবৈধ বিদেশি কর্মী কাজ করছেন, যাদের কোনও ওয়ার্ক পারমিট নেই। তারা কোথায়, কোন কারখানায়, কী কাজ করছেন, কত টাকা বেতনে কাজ করছেন তারও কোনও হিসাব নেই। এর ফলে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব।
সরকারি বিধি অনুযায়ী, কোনও বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কোনও ধরনের কাজ করতে আগ্রহী হলে তাকে ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কাজের জন্য অনুমতি বা ‘ওয়ার্ক পারমিট’ নিতে হবে। বিদেশি কর্মীদের ই-ভিসার মাধ্যমে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) এই অনুমতি দেবে। বিডার অনুমতি পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা ছাড়পত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-টিআইএন এবং ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। এই হিসাবে বিদেশি কর্মীর বেতন জমা হবে।
একই সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী বিদেশি কর্মীদের আয়কর রিটার্নও দাখিল করার বিধান রয়েছে। অথচ এসব নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে হাজার হাজার বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে, সরকারকে তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে।
গত ২৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী লিখিতভাবে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশিরা ১৩০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে ভারতীয়রা তাদের দেশে নিয়ে গেছেন ৫০ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার। [২৮ জুন ২০২৪, বাংলা ট্রিবিউন]
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশিরা ১৩০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর মধ্যে ভারতীয়রা তাদের দেশে নিয়ে গেছেন ৫০ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার।
জাতীয় সংসদে ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কাদের আজাদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা জানান অর্থমন্ত্রী। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরের আয় সংশ্লিষ্ট তথ্য বাংলাদেশে ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকেরা তাদের আয় থেকে ১৩০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার নিজ দেশে নিয়ে গেছেন।
কোন দেশের নাগরিকরা কত ডলার নিয়েছেন সেই তথ্য জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ভারতীয়রা ৫০ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার, চীনারা ১৪ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কানরা ১২ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার, জাপানিরা ৬ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলার, কোরিয়ানরা ৬ দশমিক ২১ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছেন। এছাড়া থাইল্যান্ড ৫ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্য ৩ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান ৩ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ৩ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়া ২ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকরা ২১ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার নিজ দেশে নিয়ে গেছেন।
চট্টগ্রাম-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি মাহবুব উর রহমানের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মরত কোনও ব্যাংকেই আর্থিক সংকট নেই। তবে কিছু ব্যাংকে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সমস্যা বিদ্যমান আছে। এসব সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন করে কর্মকর্তা ৯টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক হিসেবে এবং ৭টি ব্যাংকে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
এমপি আব্দুল লতিফের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে আসা, খাদ্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য উদ্যোগ এবং অসহায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেবার জন্য যেসব কার্যক্রম চলছে তার প্রভাবে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমরা মনে করছি।
এমপি আব্দুল লতিফের অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চলমান সংকটের মূলে যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো, বৈশ্বিক পণ্য বাজারে সরবরাহে অনিশ্চয়তা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া এবং দেশের বাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি। অর্থনৈতিক এই সংকট কাটিয়ে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের সরকারদলীয় এমপি এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আমানতকারীরা নানাবিধ স্কিম, ক্ষুদ্র শিল্প খাতসহ আয়-উৎসারী বিভিন্ন খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করছেন। ফলে আস্থাহীনতা ও মূল্যস্ফীতির কারণে নয়, বরং বিবিধ বিনিয়োগ প্রকল্প আকর্ষণীয় হওয়ায় ও সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ