সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় মাঠে থাকা পুলিশের অনেক ইউনিট কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আন্দোলনকারীদের সরানোর পরিবর্তে আত্মরক্ষাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ সদস্যদের। জনরোষে পড়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন অধিকাংশ সদস্য।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে রায়ট গিয়ার (হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, বুট, লেগগার্ড) পরা অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার পাঠাতে হয়। কোথাও কোথাও আটকে পড়া সদস্যদের উদ্ধারে পাঠানো হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও সাঁজোয়া যান।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর এখন আলোচনা শুরু হয়েছে দাঙ্গা দমনে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে। এর কারণ খুঁজতে শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসনও। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজি আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকেকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভেবে প্রথমে নমনীয় ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। পরবর্তী সময়ে বিক্ষুব্ধরা বেপরোয়া হয়ে ওঠায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
অবরুদ্ধ হওয়া পুলিশ সদস্যরা ফিরে এসে বলেছেন, এমন ভয়াবহ জনরোষ আগে কখনো দেখেননি তাঁরা। দুই দিকের মানুষের চাপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খেই হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। করণীয় জানতে ঊর্ধ্বতনদের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতনেরা মাঠের পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তা ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, তার কখনো প্রশিক্ষণও পাননি তাঁরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে টানা তিন দিন (বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবার) রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা ও পুলিশের থানা, ফাঁড়ি ও কার্যালয়ের ৮১ স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। হামলায় ঘটনাস্থলেই দুজনসহ মৃত্যু হয় তিন পুলিশের। আহত তিন শতাধিক।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা বা নানান ইস্যুতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গের দায়িত্ব থাকে পুলিশের ওপর। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে বলা হয়, এই প্রক্রিয়ায় কোনো বিক্ষোভকারী যেন মারাত্মক জখম না হয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদও যেন অক্ষুণ্ন থাকে। তবে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন চাইলে লাঠিপেটা এমনকি গুলিও করার অনুমতি থাকে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের অ্যাকশনে যাবে, পুলিশ সদস্যদের এমন বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থায় পড়লে উপস্থিত বুদ্ধিতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ।
দাঙ্গা দমনের ব্যর্থতার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কোথাও কোথাও অবস্থান এমন ছিল—সড়কের দুই প্রান্তে বিক্ষোভকারীরা এবং মাঝে পুলিশ। দুই দিক দিয়ে আটকে যায় তারা। কখনো হামলা প্রতিহত করে সামনে এগিয়েছে, আবার কখনো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। তখন আশপাশে সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর হলেও জনরোষ ঠেলে সেখানে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না তাদের।
ডিএমপির সূত্রটি বলছে, পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, আন্দোলনকারীরা পুলিশের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের টার্গেট ছিল পুলিশ। আবার আন্দোলনকারীদের তুলনায় পুলিশ সদস্যদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। মূল সড়কের আশপাশে অলিগলিতে বিক্ষুব্ধরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় পুলিশ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। অবরুদ্ধ থাকা এক ইউনিট অন্য ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছিল না।
রামপুরা এলাকায় দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আন্দোলনের শুরুর দিকে ঊর্ধ্বতনদের এবং কন্ট্রোলরুম থেকে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা আসছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ওয়াকিটকিতে শুধু শোনা যাচ্ছিল পাশে হামলা হচ্ছে, অবস্থা ভয়াবহ। মাঠে থাকা সদস্যরা তখন সবাই ঘাবড়ে যান। কী করতে হবে, ঊর্ধ্বতনরাও বলতে পারছিলেন না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের পদস্থ এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকেকে বলেন, একমাত্র গুলি চালিয়ে পুলিশ সদস্যরা বের হতে পারতেন। কিন্তু আন্দোলনকারীদের সামনে শিক্ষার্থীরা থাকায় এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না।
মাঠের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার গণমাধ্যমকেকে বলেন, বিপুলসংখ্যক হামলাকারীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু জীবন বাজি রেখে রাস্তায় পড়ে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা।
এদিকে দাঙ্গা দমনে ব্যর্থতা প্রসঙ্গে পুলিশ সদস্যদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ না থাকার বিষয়টিও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রশিক্ষণ-১ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম বলেন, পুলিশ সদস্যদের নিয়োগের সময় মৌলিক প্রশিক্ষণে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গে কী করণীয়, তা বলা হয়। পুলিশ প্রবিধানও রয়েছে। তবে সেটার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না।
অথচ দুই বছর আগে পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জনরোষের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে তাঁরা বিশেষ মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ সেন্টারের প্রশিক্ষণব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে বলা হয়। সঙ্গে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এক বছর ও বাস্তব প্রশিক্ষণ দুই বছর করার সুপারিশ করা হয়।
এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক গণমাধ্যমকেকে বলেন, ‘সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের যে প্রস্তুতি, দক্ষতা ও কৌশল দরকার, তা আমাদের পুলিশের নেই। উন্নত দেশের পুলিশকে প্রতিটি ঘটনা মোকাবিলার জন্য আলাদা কৌশল শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের এখনো ট্র্যাডিশনাল পুলিশিং চলছে, এর উন্নতি দরকার।’
আপনার মতামত জানানঃ