কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি সুন্দরী নারীর ছবি যেন নারীর স্টেরিওটাইপিং চিত্রকেই প্রতিফলিত করে।
এআই’র দৃষ্টিতে সুন্দরী নারী বিষয় লিখে দিলেই সে অনুযায়ী ছবি বা ছবির আবহ তৈরি করতে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি। আর তাই নিজেদের কল্পনা ও পছন্দকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের ছবি তৈরি করেন অনেকেই।
কীবোর্ডের কয়েকটা শব্দের ছোঁয়াতেই নিজের কল্পনার সুন্দরী নারী বা পুরুষের ছবিও তৈরি করে নেয়া যায়।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি সুন্দরী নারীর ছবি নারীর স্টেরিওটাইপিং চিত্রকেই প্রতিফলিত করে।
এআইকে যখন একজন সুন্দরী রমণীর ছবি তৈরির লিখিত প্রম্পট দেয়া হয়, তখন বেশিরভাগ এআই মডেলের ফলাফল প্রায় একই ছিল। চেহারায় ভারী মেকআপ, হালকা পাতলা গড়ন, আঁটসাঁট গোলাকার বক্ষ— অনেকটা যেন বার্বি পুতুলের মতো। আপনার মনে হতে পারে এমন কাউকে হয়ত ইন্সটাগ্রামে আপনি নিশ্চিত দেখেছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দিয়ে ছবি তৈরি করে এমন তিনটি মডেল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ডিএএলএল-ই এআই মডেল, সংকর জাতির ভারী সাজগোজ করা, চিকন শরীরের নারীদের ছবি প্রদর্শন করে, যাদের মধ্যে ৬২ শতাংশের ত্বকের বর্ণ ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা।
মিডজার্নি মডেলের নারীদের বড় গাউন ও লো কাট টপস পরতে দেখা যায়। ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই ত্বকের রঙ ছিল ফর্সা।
স্ট্যাবল ডিফিউশন নামের আরেকটি মডেলও হালকা গড়নের সুন্দর পোশাকের নারীর ছবি দেখায়। বাকি তিনটি মডেলের মধ্যে এটিতেই সর্বাধিক— ১৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর উপস্থিতি ছিল।
এআই সৃষ্ট চিত্রগুলোই বিনোদন, বিপণন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয় প্রতিনিয়ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একজন সুন্দর নারী বলতে আসলে কী বুঝে তা জানতেই এই অনুসন্ধানে নামে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
সুন্দরী নারীর ছবি তৈরির প্রম্পট দেয়া হলে, তিনটি মডেলই স্লিম বা চিকন নারীদের ছবি উপস্থাপন করে। এদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ নারীরা ছিলেন শ্যামলা এবং ৯ শতাংশ নারী ছিলেন কৃষ্ণ বর্ণের। আর মাত্র ২ শতাংশ ছবির নারীদের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ দেখা গেছে।
এমনকি যখন স্বাভাবিক নারীর চিত্র তৈরির জন্য প্রম্পট দেয়া হয় তখনও স্লিম ফিট গড়নের নারীর চিত্র তৈরি করে। আর গড়ে ৯৮ শতাংশই ছিলেন ফর্সা বর্ণের।
এআই শিল্পী আব্রান মালডোনাডো বলেন, বিভিন্ন বর্ণের মানুষের কাল্পনিক ছবি তৈরি করা সহজ হয়ে গেলেও, বেশিরভাগ মডেলের তৈরি মানুষের নাক অ্যাংলোদের মতো এবং দেহের গঠন ইউরোপিয়ানদের মতো। গায়ের রং বাদে বাকি সবকিছুই একই।
ক্রিয়েট ল্যাবসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মালডোনাডো জানান, গত বছর মিডজার্নির এআই মডেলে স্বাভাবিক দেহের প্রাপ্ত বয়স্ক একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর ছবি তৈরির জন্য তাকে নারী অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছিল।
এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মোটা’ শব্দটা ব্যবহার না করা পর্যন্ত এটি স্বাভাবিক গঠনের নারীর অবয়ব তৈরি করছিল না।’
এই স্টেরিওটাইপগুলো যে হয়ে থাকে তা প্রতিষ্ঠানগুলো জানে। ডিএএলএল-ই’এর নির্মাতা ওপেনএআই গত অক্টোবরে স্বীকার করে যে, ‘সৌন্দর্যের স্টেরিওটাইপিকাল এবং গতানুগতিক ধারণার প্রতি মডেলটির পক্ষপাত, শরীরের গঠনের ওপর তাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে জোরালো ভাবে প্রতিফলিত করে, যা অসন্তুষ্টি ও বিরক্তির কারণ হতে পারে।’
জেনারেটিভ এআইও একই রকম সংকীর্ণ চিন্তাধারায় কাজ করে, বিভিন্ন দেহের ধরণ এবং উপস্থিতির প্রতিনিধিত্ব তাদের মডেলেও দেখা যায় না।
শরীরের আকারই একমাত্র সমস্যা ছিল না। যখন প্রশস্ত নাকযুক্ত নারীদের দেখাতে বলা হয়েছিল, তখন তিনটি মডেলের এক চতুর্থাংশেরও কম চিত্র বাস্তবসম্মত ছিল। ডিএএলএল-ই দ্বারা নির্মিত প্রায় অর্ধেক নাক ছিল কার্টুনিশ বা অবাস্তব।
কিন্তু অন্যদিকে এআই মডেলগুলো ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ওপেনএআই, তাদের নতুন ‘সোরা’ এআই মডেল হলিউডের সিনেমায় ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে—যেটি কিনা নির্দেশিত লেখা অনুযায়ী ভিডিও তৈরি করতে পারে।
ওপেনএআই বলছে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক নামক একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জনপ্রিয় ইমেজ টুলগুলো পশ্চিমা বাদে অন্য সংস্কৃতির নারীদের বাস্তবসম্মত চিত্র তৈরি করতে হিমশিম খায়। প্রম্পটে এশীয় বংশোদ্ভূত একক ভাঁজ চোখের পাতাযুক্ত নারীর ছবি তৈরির নির্দেশনা দেয়া হলে, তিনটি এআই মডেলই ১০ শতাংশেরও কম সময় সঠিক ছিল।
সবচেয়ে বেশি ভুল ফলাফল দিয়েছে মিডজার্নি। মাত্র ২ শতাংশ চিত্র নির্দেশিত প্রম্পটের সাথে মেলে। বেশিরভাগ ছবিই ছিল ফর্সা ত্বকের নারীর ছবি।
এই সমস্যাগুলো সমাধান করা ব্যয়বহুল এবং চ্যালেঞ্জিং, কারণ এখনও মডেলগুলো ডেভেলাপিং পর্যায়ে আছে। অ্যালেন ইনস্টিটিউট ফর এআই-এর ফলিত গবেষণা বিজ্ঞানী লুকা সোলদাইনি, যিনি এর আগে অ্যামাজনে এআই নিয়ে কাজ করেছিলেন, তিনি বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো ‘প্রাক-প্রশিক্ষণ’ পর্যায়ে কোনো পরিবর্তন আনতে চায় না কারণ মডেলগুলো ‘রান’ করা হলে বিশাল ডেটাসেট প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজন হয়, যার জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ হতে পারে।”
তার মতে, এর থেকে ডেভেলাপাররা ব্যবহারকারীর অনুরোধে নির্দিষ্ট শব্দ যুক্ত করে চিত্রগুলোতে বিভিন্ন জাতি এবং লিঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মডেলটিকে নির্দেশ দিতে পারে।
এআই ব্যবহার করে বানানো আরেক সুন্দরী নারী। ছবি: টিবিএস
গুগলের চ্যাটবট জেমিনি এ বছরের শুরুতে ‘১৯৪৩ সালের এক জার্মান সৈনিককে’ একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও একজন এশীয় নারী হিসেবে চিত্রিত করে সমালোচনার মুখে পড়ে। যখন ‘একজন ঔপনিবেশিক আমেরিকান’ এর ছবি চাওয়া হয়, চারজন কৃষ্ণ বর্ণের ব্যক্তির ছবি উপস্থাপন করে যাদেরকে দেখে নেটিভ আমেরিকান বলে মনে হয়েছিল।
গুগল পরে ক্ষমা চাইলেও ভুলের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। তবে কিছু ডানপন্থি ব্যক্তি দাবি করেছেন যে টেক জায়ান্টটি ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
গুগল, মিডজার্নি এবং স্টেবল ডিফিউশনের এর ডেভেলপার স্ট্যাবিলিটি এআই, মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
ওপেনএআই-এর এআই প্রধান সন্ধিনী আগরওয়াল বলেন, ‘পক্ষপাতদুষ্টতা ঠিক করার চেষ্টা করার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটি এআই মডেলের আচরণকে গাইড করার জন্য কাজ করছে।’
এআই-তে লিঙ্গকে বৈচিত্র্যময় করা প্রযুক্তিগতভাবে চ্যালেঞ্জিং। উদাহরণস্বরূপ, যখন ওপেনএআই ডিএএলএল-ই ২ এর প্রশিক্ষণ ডেটা থেকে সহিংস এবং যৌন আবেদনময়ী চিত্রগুলো সরাতে চেষ্টা করে, তখন তারা দেখতে পায় যে মডেলটি নারীদের চিত্র সঠিক সংখ্যায় তৈরি করতে পারছিল না, কম চিত্র তৈরি করছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়, ডেটাসেটে থাকা নারীদের একটি বড় অংশের ছবি পর্নোগ্রাফি এবং সহিংস চিত্রাবলি থেকে প্রাপ্ত।
ওপেনএআই তখন ইচ্ছাকৃতভাবে এআই মডেলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত ডেটাসেটে এই জাতীয় চিত্রগুলো রেখে দেয়।
ওপেন সোর্স এআই স্টার্ট-আপ হাগিং ফেসের গবেষণা বিজ্ঞানী সাশা লুসিওনি বলেন, ‘এআই ইমেজ জেনারেটরগুলো কীভাবে বিকশিত হয় তা আপনি যত গভীরভাবে দেখবেন, তত বেশি স্বেচ্ছাচারী এবং অস্বচ্ছ বলে মনে হবে।’
সুন্দরী নারীর পর এবার, অসুন্দর নারীর চিত্র তৈরির নির্দেশনা দেয়া হলে, মিডজার্নি এবং স্ট্যাবল ডিফিউশন অসুন্দর হিসেবে ‘বয়স্ক’ নারীদের চিত্র উপস্থাপন করে। বার্ধক্যের ছাপ পড়লেই যে কেউ অসুন্দর হয়ে যান, এরকমও কিন্তু না।
লুসিওনি বলেন, ‘মানুষ প্রায়শই ধরে নেয় যে এই ফলাফলগুলো সম্পূর্ণরূপে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আসে। তবে বাস্তবে, অল্প সংখ্যক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত এর পেছনে থাকে। যখন এআই মডেলগুলোকে প্রচলিত সৌন্দর্যের মানদণ্ডের বাইরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়, তখনই তারা অবাস্তব ফলাফল তৈরি করে।’
নির্মাতা বিপণন সংস্থা বিলিয়ন ডলার বয়ের একটি জরিপে দেখা গেছে যে ৯২ শতাংশ বিপণনকারীরা ইতিমধ্যে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করে ডিজাইন করা সামগ্রী কমিশন করেছে এবং ৭০ শতাংশ বিপণনকারি এই বছর জেনারেটিভ এআইতে ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে।
ক্রিয়েট ল্যাবসের মালদোনাদো উদ্বিগ্ন এটা ভেবে যে, এই মডেলগুলো জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য চিত্রিত করার পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত স্টেরিওটাইপ ভাঙার অগ্রগতিতে বাধা দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ