৩০ বছর ধরে, টাইগার বিটলের এমন শব্দ তৈরির বিষয়টি নিয়ে সন্ধিহান ছিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে, সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় এ রহস্যের সমাধান মিলেছে।
রাতের উড়ন্ত পোকামাকড়ের প্রধান শিকারী হল বাদুড়। অন্ধকারে শিকার করার জন্য এরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে, তার নাম ‘ইকোলোকেশন’।
মথ, পোকামাকড়, ঝিঁঝি ও ফড়িং’সহ অনেক কীটপতঙ্গ বাদুড়ের উচ্চ কম্পাঙ্কের আওয়াজ শনাক্ত করতে, নিজেদের কানকে সেভাবে বিবর্তিত করে নিয়েছে।
তবে, বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে ‘টাইগার বিটল’ নামের পোকাটি, যারা বাদুড় কাছাকাছি অবস্থায় থাকলে নিজস্ব ‘আল্ট্রাসনিক’ সংকেত তৈরি করতে পারে।
৩০ বছর ধরে, টাইগার বিটলের এমন শব্দ তৈরির বিষয়টি নিয়ে সন্ধিহান ছিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে, সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় এ রহস্যের সমাধান মিলেছে।
এ গবেষণার প্রধান লেখক হারলান গফ, যিনি গবেষণাটি নিয়ে কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফ্লোরিডা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’তে। আর এটি প্রকাশ পেয়েছে ‘বায়োলজি লেটার্স-এ।
পিয়ার-রিভিউড ওই জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে গফের দাবি, নিজেদেরকে বাদুরের কাছে আরও শনাক্তযোগ্য করে ফেলার ঝুঁকি থাকার পরও এইসব পোকার এমন শব্দ তৈরির সক্ষমতা থেকে আরও বেশি সুযোগ নেওয়া উচিৎ।
বাদুড়ের আক্রমণের ঝুঁকির বিপরীতে ‘আল্ট্রাসাউন্ড’ তৈরির বিষয়টি অন্যান্য পোকার চেয়ে আলাদা করে তোলে টাইগার বিটলকে। উদাহরণ হিসেবে, মথ প্রজাতির ২০ শতাংশ এমনটি করতে পারলেও, টাইগার বিটলের এমন আচরণ থেকে পুরোপুরি নতুন এক ব্যাখ্যা মিলেছে।
বাদুড় আশপাশে থাকলে টাইগার বিটল যে সত্যিই আলট্রাসাউন্ড উৎপন্ন করে, সে বিষয়টি গবেষণার শুরুতেই নিশ্চিত করেছেন গফ ও তার গবেষণা দলটি।
এজন্য গবেষকরা দক্ষিণ অ্যারিজোনার মরুভূমিতে দুই গ্রীষ্ম কাটিয়ে ২০ প্রজাতির টাইগার বিটল নিয়ে গবেষণা করেছেন।
এতে দেখা যায়, সাতটি প্রজাতি নিজেদের ‘ইলিট্রা’ (ডানা ঢেকে রাখার মতো শক্ত খোসা) কিছুটা পেছনে নিয়ে বাদুড় আক্রমণের শব্দের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এ গতিবিধির কারণে এদের পেছনের ডানাগুলো ইলিট্রার প্রান্তে আঘাত হানার মাধ্যমে মৃদু গুঞ্জনের শব্দ তৈরি করে। মানুষ এ শব্দ খুবই আবছাভাবে শুনতে পেলেও, বাদুড়ের কানে এমন উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ স্পষ্টভাবে গিয়ে পৌঁছায়।
গফ উল্লেখ করেছেন, অনেক পোকামাকড় বাদুড়ের শব্দ শুনতে পেলেও কেবল হাতে গোনা কয়েকটি পোকাই নিজস্ব শব্দ দিয়ে এর প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। যেমন– মথের দেহে প্রায়শই এমন শব্দ তৈরির বিশেষ কাঠামো থাকে। তবে নিজের ডানা ও ইলিট্রা ব্যবহার করে পুরোপুরি ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে টাইগার বিটল।
টাইগার বিটল কেন এ ধরনের শব্দ তৈরি করে, তা বুঝতে গবেষকরা বেশ কিছু তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। তাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, কিছু মথের মতো বিটলরাও বাদুড়ের চলাচলের পথ বন্ধ করতে এমন শব্দ ব্যবহার করছে। তবে, তারা দ্রুত এ ধারণা বাতিল করে দেন কারণ বিটলের এই শব্দ খুবই সাধারণ বিষয় ছিল।
এর পর তারা বিবেচনা করেছিলেন, পোকাগুলো যে বিষাক্ত, সে বিষয়ে বাদুড়কে সতর্ক করতে তারা এমন শব্দ ব্যবহার করে থাকে কি না। আর অনেক টাইগার বিটলই বেনজালডিহাইড ও হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো প্রতিরক্ষামূলক রাসায়নিক উপাদান তৈরি করতে পারে।
বিষয়টি পরীক্ষা করতে গবেষকরা বড় এক বাদামী রঙের বাদুড়কে ৯৪টি টাইগার বিটল খাওয়ান। বিস্ময়করভাবে এরা ৯০টি বিটল পুরোপুরি খেয়ে ফেললেও মাত্র দুটি পোকা খায়নি। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, এইসব পোকার দেহে তৈরি হওয়া রাসায়নিক উপাদান বাদুড়ের বিরুদ্ধে অতটা কার্যকর নয়।
এ গবেষণার সর্বশেষ তত্ত্বটি ছিল, টাইগার বিটল সম্ভবত বাদুড়কে বোকা বানাতে বিষাক্ত মথের শব্দ নকল করে। পরবর্তীতে, টাইগার মথ ও টাইগার বিটলের শব্দের রেকর্ডিং তুলনা করার পর গবেষকরা এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পান।
এর ফলে গবেষকরা নিশ্চিত হন, টাইগার বিটল বাদুড়ের জন্য বিষাক্ত নয়, বরং নিজেদেরকে বাঁচাতে এরা টাইগার মথের আল্ট্রাসনিক সংকেত অনুকরণ করে।
তবে, মজার বিষয় হল— এমন আচরণ শুধু নিশাচর টাইগার বিটল-এ পাওয়া যায়। ১২টি প্রজাতির এমন টাইগার বিটল আছে, যেগুলো দিনের বেলা সক্রিয় থাকে। আর এরা নিজেদের দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য পোকামাকড় শিকার করলেও বাদুড়ের শব্দে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, এগুলো বাদুড়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, এরা অন্যান্য প্রজাতির টাইগার বিটলের মতো একই ধরনের হুমকির মুখে পড়ে না।
এ গবেষণায় উঠে এসেছে, নিশাচর পোকামাকড়ের আল্ট্রাসনিক শব্দ অনুকরণের বিষয়টি এর আগের প্রচলিত ধারণার চেয়েও সাধারণ বিষয় হতে পারে।
তবে, মানুষের শব্দ ও আলো দূষণের মতো কার্যক্রমে এইসব সূক্ষ্ম পরিবেশগত মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে নোরিজ।
এইসব প্রক্রিয়া বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাদের পরিবেশে এ ধরনের পরিবর্তন বন্যজীবনের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ