করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব ইতোমধ্যেই নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। এরইমধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বার্ড ফ্লু। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা গেছে, ভারতের অন্তত ১০টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বার্ড ফ্লু। সেই প্রেক্ষিতে সারাদেশে সতর্কতা জারি করেছে মোদি সরকার। এছাড়া কোথাও কোথাও পুরো খামার সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি হাজার হাজার মুরগি মেরে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে। বার্ড ফ্লু ভাইরাস বিশেষ করে হাঁস-মুরগির মধ্যে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় ভারত থেকে হাঁস-মুরগি-ডিম আনা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে অবৈধভাবে চোরাপথেও এসব প্রাণী যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর প্রশাসনকে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, ‘আমরা কেবল সতর্কতামূলকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও বাংলাদেশে এখনো কোনো জেলায় বার্ড ফ্লু’র সংক্রমণ দেখা যায়নি। এখানে খামারি বা ক্রেতাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভারতে যেখানে রোগটি শনাক্ত হয়েছে, তা বাংলাদেশ থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া ভারতও ওইসব এলাকায় সতর্কতা জারি করেছে। আমরা আমাদের মাঠকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছি। কোনো প্রকার উপসর্গ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আমাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা তো আছেই। তাই ক্রেতাসাধারণকে অনুরোধ করব, আতঙ্কিত হয়ে আপনারা হাঁস-মুরগি বা ডিম খাওয়া বন্ধ করবেন না।’
নিষিদ্ধের ব্যাপারে গত মঙ্গলবারই পৃথক তিনটি চিঠি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. ইফতেখার হোসেন। তিনি জানান, ‘ভারত থেকে কোনোভাবেই যাতে মুরগির বাচ্চা, হাঁস-মুরগি, পাখি ও ডিম আমদানি না হয় সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে এ রোগের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে সীমান্ত পথে বৈধ ও অবৈধভাবে মুরগির বাচ্চা, প্যারেন্টস্টক, হাঁস-মুরগি, পাখি ও ডিমের অনুপ্রবেশ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সমুদ্র, নৌ এবং স্থলবন্দর দিয়ে মুরগির বাচ্চা, প্যারেন্টস্টক, হাঁস-মুরগি, পাখি ও ডিমের অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল জব্বার শিকদার গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, ভারতের যেসব এলাকায় বার্ড ফ্লু সংক্রমিত হয়েছে সেসব এলাকা আমাদের সীমান্ত এলাকায় নয়। এরপরও আমরা সতর্ক রয়েছি। ইতিমধ্যে সব খামারিকে সতর্ক করা হয়েছে। সরকারি খামারগুলোতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বার্ড ফ্লুর কোনো রকম উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য খামারিদের বলা হয়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ডিম বা মুরগি খাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু হাদী নুর আলী খান গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশে সাধারণত এইচ৫এন১, এইচ৫এন২, এইচ১এন১ ও এনএন২ প্রজাতির ভাইরাস দেখা যায়। ‘টাইপ-সি, টাইপ-ডি, টাইপ-এ’ তিন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার মধ্যে আমাদের দেশে দেখা যায় টাইপ-এ। এটাকে অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বলে। একসময় এই ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হতো। মানুষ মারা যেত। এখন ভাইরাস তার রূপ পরিবর্তন করেছে। মানুষে খুবই কম সংক্রমিত হয়। মৃত্যুর সংখ্যাও কম। আমরা জিনোম সিকোয়েন্স করেছি। অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা তার রূপ পরিবর্তন করেছে। তাতে দেখা গেছে, মানুষকে সংক্রমিত করার যে ক্ষমতা, সেটা সে অর্জন করেনি।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসীন বলেন, ভারতের হায়দ্রাবাদ, পশ্চিম বাংলার মেদিনিপুর, আসামসহ ৮-১০টি প্রদেশে এই রোগ দেখা দিয়েছে। ভারত সময়মতো তথ্য না দেওয়ায় প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। আমাদের দেশে ২০১৩ সাল থেকে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন চালু আছে। এই ভ্যাকসিনের পরে দেশে বার্ডফ্লুর কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। তবে সম্প্রতি ভ্যাকসিনটি আর সেভাবে কাজ করছে না।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এখন দেশে ৮৮ হাজার পোলট্রি ফার্ম চালু আছে। মোট ফার্মের সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজারের বেশি। এই শিল্পে বিনিয়োগ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সপ্তাহে উৎপাদন হচ্ছে ৬৫ লাখ মুরগির বাচ্চা।
ভারতে দেখা দেওয়ার পর আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের বলেছি যে, বায়োসেফটি বা জৈব নিরাপত্তা শক্ত রাখতে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়াসহ জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী থেকে খামারের প্রাণীদের আলাদা রাখতে হবে।
অধ্যাপক ড. আবু হাদী নুর আলী খান বলেন, অধিকাংশ ফার্মের বায়োসিকিউরিটি বা জৈব নিরাপত্তা ভালো না। খামারে যাতে অন্য কোনো পাখি, ইঁদুর ঢুকতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মুরগির বাচ্চাগুলো আনতে হবে সুস্থ পরিবেশ থেকে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়াবে না। ভাইরাসটা যেহেতু হাঁস, দেশি মুরগিতে আছে, সেখান থেকে সহজেই খামারে ঢুকে যাচ্ছে।
ভ্যাকসিন ব্যবহারে সতর্ক করে দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে। বাংলাদেশে প্রায় চার ধরনের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি। কিন্তু ভ্যাকসিন হচ্ছে একটা কি দুটির বিরুদ্ধে। ফলে ভ্যাকসিন সেভাবে কাজ করছে না। আমাদের খামারগুলোতে ঠিকমতো আলো-বাতাস আসা-যাওয়া করে না, ভেন্টিলেশন ভালো না। রাতের বেলা চট দেওয়া হয়, কিন্তু পলিথিন দেওয়া হয় না। এসব কারণে মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন শ্বাসনালির জীবাণুগুলো সক্রিয় হয়। তখন অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জাকে বাড়তে সহায়তা করে। কিন্তু খামারে এসব ব্যবস্থা ঠিকমতো থাকলে এই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে না। খামারিদের এক খামার থেকে আরেক খামারে যেতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, খামারে কাক, শালিক, চড়ুই, দেশি মুরগি, হাঁস যাতে না ঢোকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে মুরগির বাচ্চাগুলোর ওজন ৩৫ দিনে দেড় থেকে পৌনে দুই কেজি করার নিয়ম। কিন্তু খামারিদের লক্ষ্য থাকে ২৮ দিনে পৌনে দুই কেজি করার। সাত দিন খাবার কম দিয়ে ওজন বাড়ানোর জন্য ওষুধ খাওয়ায়। তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সেটা করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা ভাইরাসের মতোই বার্ড ফ্লু ভাইরাসটিকে আমাদের আগে থেকে আমলে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। দুটি ভাইরাস একসাথে আক্রমণ শুরু করলে তখন আর কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চোরাইপথে অধিকতর নজর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। যাতে কোনোভাবেই দেশে ভারতের হাঁস মুরগি ডিম ইত্যাদি না আসে। একটু অবহেলার জন্য আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ