করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব ইতোমধ্যেই নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। এরইমধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বার্ড ফ্লু। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউরোপে এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এরইমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে। গত কয়েক দিনে ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়ার বেশ কিছু জায়গায় মারাত্মক বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (ওআইই)। এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিনে সংক্রামক বার্ড ফ্লুর বিস্তার গুরুতর রূপ নিয়েছে।
প্রাণিস্বাস্থ্যবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ওআইইর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, আবারও খুব দ্রুত ভাইরাসটির বিস্তার বাড়ছে বলে প্রমাণ মিলেছে।
পাখি ও পাখি জাতীয় প্রাণীর মধ্যে অতি সংক্রামক ও ক্ষতিকর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সাধারণভাবে বার্ড ফ্লু হিসেবে পরিচিত। বার্ড ফ্লু হিসেবে পরিচিত অতি-সংক্রামক এই এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তার বিশ্বজুড়ে পোল্ট্রি শিল্পকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থামাতে অতীতে লাখ লাখ পাখি, হাঁস ও মুরগিকে হত্যা করা হয়েছে। বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের কারণে পোল্ট্রি বাণিজ্যে প্রায়ই বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
ভাইরাসটি মানুষের মধ্যেও ছড়াতে পারে। যে কারণে মহামারিবিদরা আগে থেকেই বার্ড ফ্লুর ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এ বছর চীনে ২১ জন মানুষের দেহে বার্ড ফ্লুর অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫এন১ শনাক্ত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি।
দক্ষিণ কোরিয়ার চুংচিওংবুক-দো শহরে প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার মুরগির একটি খামারে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে বলে সোমবার বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানিয়েছে দেশটি। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে ওআইই। কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ ওই খামারের সব মুরগিকে মেরে ফেলেছে।
গত সপ্তাহে জাপানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, চলতি শীত মৌসুমে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি মুরগির খামারে বার্ড ফ্লুর প্রথম প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার এইচ৫এন৮ ধরনের কারণে এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়।
ওআইই বলেছে, ইউরোপে এইচ৫এন১ বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব নরওয়ের রোগাল্যান্ড অঞ্চলে শনাক্ত হয়েছে। সেখানকার ৭ হাজার মুরগির একটি খামারে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়।
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব সাধারণত শরৎকালে দেখা যায় এবং এই ভাইরাসটি পরিযায়ী বুনো পাখির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বেলজিয়ামের সরকার দেশটিকে বার্ড ফ্লু প্রাদুর্ভাবের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বার্ড ফ্লুর একটি অতি-সংক্রামক ধরন অ্যান্টওয়ার্পের কাছে বুনো হাঁসের শরীরে শনাক্ত হওয়ার পর সোমবার দেশটির সরকার হাঁস-মুরগি, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীকে বাড়ির ভেতরে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রতিবেশী ফ্রান্সে এবং গত অক্টোবরে নেদারল্যান্ডসে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, পোল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫ এবং এই৫এন১ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটছে। ব্রিটেনের কৃষি মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছে, ইংল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলের একটি ছোট পোল্ট্রি ফার্মে অতি-সংক্রামক এইচ৫ বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে। ওয়ারউইকশায়ারের আলসেস্টারের কাছের ওই খামারের সব মুরগি মেরে ফেলা হবে।
দেশজুড়ে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধ অঞ্চল ঘোষণা করার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে নতুন এই প্রাদুর্ভাবের খবর এল ব্রিটেনে। গত সপ্তাহে দেশটির খামার এবং পাখি পালনকারীদের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর আগে, পূর্ব স্কটল্যান্ডের একটি পাখির খামারে, মধ্য ইংল্যান্ডের একটি পাখি উদ্ধার কেন্দ্রে এবং উত্তর ওয়েলসের কিছু মুরগির শরীরে বার্ড ফ্লুর এইচ৫এন১ ধরনটি শনাক্ত হয়।
এদিকে, সোমবার পোল্যান্ডের কয়েকটি খামারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক এইচ৫এন১ ধরন শনাক্ত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (ওআইসি) বলেছে, পোল্যান্ডে পাখিসহ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ হাঁস-মুরগির শরীরে অত্যন্ত সংক্রামক এইচ৫এনও বার্ড ফ্লুর বেশ কয়েকটি প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে।
পোলিশ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ওআইসি বলেছে, পোল্যান্ডে এইচ৫এন১ এর পাঁচটি প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে; যার মধ্যে চারটিই মোটাতাজাকরণ টার্কি খামারে এবং দেশটির পূর্বাঞ্চলের ব্রয়লার মুরগির একটি খামারে। এছাড়া দেশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি টার্কি এবং গিজ খামারেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫ এবং এই৫এন১ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে।
এদিকে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির কারণে ফরাসি কৃষকদেরকে তাদের হাঁস-মুরগি ঘরের ভিতরে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের একটি পোল্ট্রি ফার্মে বার্ড ফ্লু সংক্রামক এইচ৫ শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ৩৬,০০০ পাখি মেরে ফেলার পর ফ্রান্সে অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশে বলা হয়েছে, পরিযায়ী পাখিদের যাত্রাপথে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফ্রান্সে ঝুঁকি বেড়েছে।
ফ্রান্সের কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগস্ট মাস থেকে ইউরোপে বন্য পাখি ও হাঁস-মুরগির খামারে ১৩০টি বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে। তবে ফ্রান্সের পেশাদার পোল্ট্রি খামারীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত কোনো সংক্রমণ দেখা দেয়নি।
ফরাসি সরকার আশা করছে, লকডাউন গত বছরের পুনরাবৃত্তি এড়াতে সাহায্য করবে। গত বছর প্রায় ৫০০টি জায়গায় বার্ড ফ্লু দেখা দিলে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হাঁস উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল।
বার্ড ফ্লু সাধারণভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু জাতীয় একটি রোগ। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নামে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে এই রোগ হয়। এটি মূলত পাখিদের সংক্রমিত করে। পাখিরা দ্রুত একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে বলে এই রোগও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষের মধ্যে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকলেও তা একেবারে অসম্ভব নয়। সাধারণত সংক্রমণের এক থেকে তিন দিন পর রোগীর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে— জ্বর, শরীরে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, ঠাণ্ডা লাগা, হাঁচি, কাশি, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, বমি ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত কোন পাখির সংস্পর্শে এলেই মানুষের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে৷ কিন্তু কেউ যদি আক্রান্ত হয় তবে তা সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷
তারা জানিয়েছেন, বসন্তকালে ভাইরাসটি আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ কারণ তখন আফ্রিকা থেকে শীতকালীন সব পাখি ইউরোপে ফিরে আসবে৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা ভাইরাসের মতোই বার্ড ফ্লু ভাইরাসটিকে আমাদের আগে থেকে আমলে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। দুটি ভাইরাস একসাথে আক্রমণ শুরু করলে তখন আর কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চোরাইপথে অধিকতর নজর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। যাতে কোনোভাবেই দেশে ভারতের হাঁস মুরগি ডিম ইত্যাদি না আসে। একটু অবহেলার জন্য আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৮
আপনার মতামত জানানঃ