করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব ইতোমধ্যেই নাজেহাল অবস্থায় রয়েছে। এরইমধ্যে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে বার্ড ফ্লু। গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপে এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরইমধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে বার্ড ফ্লুর প্রার্দুভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি পরিযায়ী সারস মারা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় খামারিদের জোরপূর্বক মুরগি মেরে ফেলতে বাধ্য করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিকে দেশটির ইতিহাসে ‘সবচেয়ে মারাত্মক বন্যপ্রাণী বিপর্যয়’ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তবে ‘পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ বলে জানিয়েছেন উরি নাভি নামে ইসরায়েলের পার্ক ও প্রকৃতি কর্তৃপক্ষের এক জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, পানির মাঝখানে অধিকাংশ পাখি মারা যাওয়ার কারণে সেখান থেকে সেগুলো পরিষ্কার করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ মন্ত্রী তামার জান্দবার্গ ‘দেশের ইতিহাসে বন্যপ্রাণীর সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইসরায়েলের বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের শঙ্কা, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক বন্যপ্রাণী বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। সেই বিপর্যয় তারা ঠেকানোর চেষ্টা করছে। ইসরায়েলের পার্ক অ্যান্ড নেচার অথরিটির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী উরি নাভি বলেন, পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বহু সারস মারা গেছে গভীর পানিতে। তাদের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ইসরায়েলের পরিবেশ রক্ষা মন্ত্রী তামার জেন্ডবার্গ বলেছেন, ‘দেশের ইতিহাসে বন্যপ্রাণীর সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি’ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
হুলা লেক পার্কের মুখপাত্র ইয়ারন মাইকেলি মনে করেন, যেখানে সারস পাখিগুলো সবচেয়ে বেশি, সেখান থেকে পার্কের কর্মীরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃতদেহগুলো সরিয়ে নিচ্ছেন। যদিও ভয়ের বিষয় হচ্ছে এগুলো থেকে অন্যান্য বন্যপ্রাণীও সংক্রমিত হতে পারে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডাফনা ইউরিস্তা মনে করেন, রোগের বিস্তার ঠেকাতে এলাকার ৫০ লাখ মুরগি জবাই করা হচ্ছে।
আফ্রিকা যাওয়ার পথে প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ সারস ইসরায়েল অতিক্রম করে জানিয়েছেন মাইকেলি। তিনি দাবি করেন, যার কিছু সংখ্যক এখানে অবস্থান করে। এবারের শীত মৌসুমে ইসরায়েলে ৩০ হাজার সারস অবস্থান করতে পারে। যদিও বর্তমানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতির পথে বলেও জানান হুলা লেক পার্কের মুখপাত্র।
দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি পরিযায়ী সারস মারা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় খামারিদের জোরপূর্বক মুরগি মেরে ফেলতে বাধ্য করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিকে দেশটির ইতিহাসে ‘সবচেয়ে মারাত্মক বন্যপ্রাণী বিপর্যয়’ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের কার্যালয় বলছে, কৃষি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। লোকজনের মধ্যে সংক্রমণ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নিও বলেও জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, সারসগুলো অন্য কোনো ছোট পাখি থেকে সংক্রমিত হয়েছে। ইসরায়েলের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে মৃত সারসের ছবি ছাপানো হয়েছে। তারা বলছে, অন্তত ১০দিন আগে থেকে সারসের মৃত্যু শুরু হয়েছে।
পাখি ও পাখি জাতীয় প্রাণীর মধ্যে অতি সংক্রামক ও ক্ষতিকর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সাধারণভাবে বার্ড ফ্লু হিসেবে পরিচিত। বার্ড ফ্লু হিসেবে পরিচিত অতি-সংক্রামক এই এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তার বিশ্বজুড়ে পোল্ট্রি শিল্পকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থামাতে অতীতে লাখ লাখ পাখি, হাঁস ও মুরগিকে হত্যা করা হয়েছে। বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের কারণে পোল্ট্রি বাণিজ্যে প্রায়ই বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
ভাইরাসটি মানুষের মধ্যেও ছড়াতে পারে। যে কারণে মহামারিবিদরা আগে থেকেই বার্ড ফ্লুর ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। এ বছর চীনে ২১ জন মানুষের দেহে বার্ড ফ্লুর অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫এন১ শনাক্ত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশি।
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব সাধারণত শরৎকালে দেখা যায় এবং এই ভাইরাসটি পরিযায়ী বুনো পাখির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বেলজিয়ামের সরকার দেশটিকে বার্ড ফ্লু প্রাদুর্ভাবের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বার্ড ফ্লুর একটি অতি-সংক্রামক ধরন অ্যান্টওয়ার্পের কাছে বুনো হাঁসের শরীরে শনাক্ত হওয়ার পর দেশটির সরকার হাঁস-মুরগি, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীকে বাড়ির ভেতরে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
গত মাসের শুরুর দিকে প্রতিবেশী ফ্রান্সে এবং গত অক্টোবরে নেদারল্যান্ডসে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, স্কটল্যান্ড, পোল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫ এবং এই৫এন১ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটছে। ব্রিটেনের কৃষি মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছে, ইংল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলের একটি ছোট পোল্ট্রি ফার্মে অতি-সংক্রামক এইচ৫ বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব শনাক্ত হয়েছে। ওয়ারউইকশায়ারের আলসেস্টারের কাছের ওই খামারের সব মুরগি মেরে ফেলা হবে।
এর আগে, পূর্ব স্কটল্যান্ডের একটি পাখির খামারে, মধ্য ইংল্যান্ডের একটি পাখি উদ্ধার কেন্দ্রে এবং উত্তর ওয়েলসের কিছু মুরগির শরীরে বার্ড ফ্লুর এইচ৫এন১ ধরনটি শনাক্ত হয়।
পোল্যান্ডের কয়েকটি খামারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক এইচ৫এন১ ধরন শনাক্ত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (ওআইসি) বলেছে, পোল্যান্ডে পাখিসহ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ হাঁস-মুরগির শরীরে অত্যন্ত সংক্রামক এইচ৫এনও বার্ড ফ্লুর বেশ কয়েকটি প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার অতি-সংক্রামক ধরন এইচ৫ এবং এই৫এন১ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে।
বার্ড ফ্লু সাধারণভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু জাতীয় একটি রোগ। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নামে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে এই রোগ হয়। এটি মূলত পাখিদের সংক্রমিত করে। পাখিরা দ্রুত একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে বলে এই রোগও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মানুষের মধ্যে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকলেও তা একেবারে অসম্ভব নয়। সাধারণত সংক্রমণের এক থেকে তিন দিন পর রোগীর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে— জ্বর, শরীরে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, ঠাণ্ডা লাগা, হাঁচি, কাশি, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, বমি ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত কোন পাখির সংস্পর্শে এলেই মানুষের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে৷ কিন্তু কেউ যদি আক্রান্ত হয় তবে তা সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷
তারা জানিয়েছেন, বসন্তকালে ভাইরাসটি আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ কারণ তখন আফ্রিকা থেকে শীতকালীন সব পাখি ইউরোপে ফিরে আসবে৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনা ভাইরাসের মতোই বার্ড ফ্লু ভাইরাসটিকে আমাদের আগে থেকে আমলে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। দুটি ভাইরাস একসাথে আক্রমণ শুরু করলে তখন আর কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চোরাইপথে অধিকতর নজর দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা। যাতে কোনোভাবেই দেশে ভারতের হাঁস মুরগি ডিম ইত্যাদি না আসে। একটু অবহেলার জন্য আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২২৮
আপনার মতামত জানানঃ