কালচারাল বিশ্লেষক ও কমিক্সের আর্থ-রাজনৈতিক পাঠে অভিজ্ঞ জিওভানি পাসকো বলেন, “১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট চোখের পলকে পুরো পৃথিবী বদলে যায়। এটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং কমিক্সের উপর সম্পূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।”
বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার তরুণ বয়স থেকেই অত্যধিক ধূমপান করতেন। একারণে তার কয়েক দফা যক্ষ্মা হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি গলার ক্যান্সারে মারা যান।
সাম্প্রতিক সময়ে ওপেনহাইমার যেন ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। কেননা বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান এই বিজ্ঞানীর জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেছেন সিনেমা।
সিনেমাটি অস্কারে সাতটি পুরস্কার লাভ করেছে। সাক্ষাত্কারে নোলান বলেন, “আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহাইমার বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। কারণ তার মাধ্যমেই মানবজাতি সমগ্র বিশ্বকে ধ্বংস করার সক্ষমতা অর্জন করেছিল।”
বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের ফলে সুখ্যাতি ও কুখ্যাতি, রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা এবং সোভিয়েত গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ সবই সিনেমাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ব যখন সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজিতে বুঁদ তখন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটি যেন এক ভিন্নধর্মী সিনেমা। যাতে কোনো সম্ভাব্য সুখকর সমাপ্তি নেই।
তবুও সিনেমাটির সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি সম্ভবত বর্তমান সময়ের সাথে এর প্রাসঙ্গিকতা। কেননা একদিকে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের পাশাপাশি তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।
অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক সংঘাত শুরুর হুমকি দিয়ে আসছেন। চলতি মাসেই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, মানবতা ‘ওপেনহাইমারের পুনরাবৃত্তিতে’ টিকে থাকতে পারবে না।
অতীতের বিষয়গুলোই যেন বর্তমানে নতুন করে আসছে। কোল্ড ওয়ার ২.০ এর লেখক মারিয়ানো আগুয়েরে বলেন, “হ্যাঁ, সময়টি বেশ ভিন্ন। আমি বলব যে, কোল্ড ওয়ারের একটি নির্দিষ্ট পুনরুজ্জীবন ঘটেছে৷ অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক, ভারসাম্যের জন্য প্রতিযোগিতা, সরাসরি সংঘর্ষের ভয় ও নৃশংস ধ্বংসের স্তরে পৌঁছানোর ধারণা দেখা যাচ্ছে।”
বইতে আগুয়েরে যুগের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। তার মতে, আজকাল দেশগুলির মধ্যে লড়াই হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের পুঁজিবাদের মধ্যে। পূর্বের মতো সমাজতন্ত্রের নিদর্শন ছাড়াই। এছাড়াও আগের মতো ‘মার্কিন বনাম ইউএসএসআর’ সমীকরণ নেই। বরং ব্লকগুলি আরও জটিল ও খণ্ডিত।
কিন্তু আগুয়েরে ১৯৪৭-১৯৯১ সময়কাল এবং বর্তমান সময়ের মধ্যে কিছু মিল তুলে ধরেছেন। যেমন, অস্ত্র সংগ্রহে প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে, পরমাণু সক্ষমতা থাকা পরাশক্তিগুলির মধ্যে পরোক্ষ দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে ও প্রক্সি যুদ্ধ হচ্ছে (যেমন ইউক্রেনের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি।
লন্ডন-ভিত্তিক চ্যাথাম হাউস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সহযোগী সদস্য অ্যাগুয়েরে মনে করেন, বর্তমানে কূটনৈতিক ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বৃদ্ধি, রুদ্ধদ্বার আলোচনা ও যোগাযোগ, জিম্মি বিনিময় বা নির্দিষ্ট মিডিয়ার প্রভাবশালী ভূমিকার ক্ষেত্রেও আগের শীতল যুদ্ধের মিল তুলে ধরেন।
জর্জ অরওয়েল সর্বপ্রথম স্নায়ুযুদ্ধের ধারণার কথা বলেছিলেন একটি আমূল ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন হিসাবে। কারণ পারমাণবিক বোমার বিকাশের ফলে পারস্পরিক আত্মবিধ্বংসী কার্যক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৯ অক্টোবর ট্রিবিউন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেন।
প্রবন্ধ ‘ইউ এন্ড এটম বোম’ এ অরওয়েল সতর্ক করেছেন যে, পারমাণবিক হুমকির মাঝে বসবাস করা ‘এমন শান্তি যা প্রকৃতপক্ষে শান্তি নয়’। বরং এটি একটি নতুন যুদ্ধের ল্যান্ডস্কেপ; যাকে তিনি স্নায়ুযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। যা এখন আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এটি নিয়ে পাবলিক রিপোর্ট, নন-ফিকশন বই এবং উপন্যাসেও লেখা হয়েছে। ২০২৩ সালে ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুগেল সতর্ক করেছে যে, আমরা যথাক্রমে আধিপত্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং উদীয়মান চীনের নেতৃত্বে দুটি বৃহৎ ব্লকের মধ্যে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষকরা সনাক্ত করেছেন যে, রাশিয়া ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের কিছু পদ্ধতিকে পুনরুজ্জীবিত করছে। যেমন, দীর্ঘমেয়াদী গুপ্তচরবৃত্তি কাজে ফ্রেশ এজেন্টদের জড়িত করার মতো বিষয়। যা সোভিয়েত যুগ থেকেই মস্কোর কাছে বেশ প্রিয় পদ্ধতি। যেমনটি হয়েছিল ম্যানহাটন প্রজেক্টের সদস্য ক্লাউস ফুচের পারমাণবিক গোপনীয়তার ক্ষেত্রে।
স্পেনের এলকানো রয়্যাল ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জেসুস এ. নুনেজ ভিলাভার্দে সতর্ক করেছেন যে, সাম্প্রতিক পদক্ষেপে ন্যাটোর পরিকল্পনায় মনে হচ্ছে ‘আমরা সেই সময়ে ফিরে আসছি যা আমরা ভুল করে ভেবেছিলাম যে কাটিয়ে উঠেছি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো, আগে আমরা বলতাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা। এখন আমরা বলছি রাশিয়ার কথা।’
কালচারাল বিশ্লেষক ও কমিক্সের আর্থ-রাজনৈতিক পাঠে অভিজ্ঞ জিওভানি পাসকো বলেন, “১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট চোখের পলকে পুরো পৃথিবী বদলে যায়। এটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং কমিক্সের উপর সম্পূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।”
সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধ কখনই শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান বোমার আঘাতে ২৪৬,০০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলে মানসিক দ্বন্দ্ব।
আমেরিকান বিজ্ঞান লেখক ও স্পেনের পালোমারেসের পারমাণবিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে ‘দ্য ডে উই লস্ট দ্য এইচ-বোম’ (২০০৯)-এর লেখক বারবারা মোরান মনে করেন, বোমার সাথে সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে সিনেমাগুলিতে ‘সম্ভবত বিকিরণ, মিউটেশন ও পারমাণবিক ধ্বংসের ভয়’ ইত্যাদি দেখানো হতো। আর এখন বোমাকে ঘিরে ‘মানুষের দুর্বলতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও রাজনৈতিক পরিণতির উদ্বেগ’ ইত্যাদি তুলে ধরা হচ্ছে।
বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক নেতারাও আবার শীতল যুদ্ধের যুগের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ। আগুয়েরে বলেন, “ভালো কিংবা খারাপের জন্য জো বাইডেন সেই সময়ে (স্নায়ুযুদ্ধ) প্রশিক্ষিত ছিলেন। পারমাণবিক শক্তিগুলির মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাব্য বিপদগুলি সম্পর্কে তিনি খুব ভালোভাবে জানেন। অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের শেষ বছরগুলিতে ইউএসএসআর-এর পতনের সময়ে পুতিন গুপ্তচর হিসাবে কাজ করেছিলেন।”
আপনার মতামত জানানঃ