নেটো সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত খাতে। নেটোর মহাসচিব মার্ক রুটে একে “একটি ঐতিহাসিক ঝাঁপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা নাকি একশো কোটিরও বেশি মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে এই বিশাল সামরিক ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি আদৌ সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা এনে দেবে কিনা, কিংবা কার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে – সেটিই এখন প্রশ্নের বিষয়।
যেখানে একসময় ২ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রাই অনেক নেটো সদস্যের কাছে দুরূহ মনে হতো, সেখানে এখন তার দ্বিগুণেরও বেশি খরচের প্রতিশ্রুতি যেন এক প্রকার বিস্ময়কর পালাবদল। ২০০২ সালে প্রথম ২ শতাংশ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও, ২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয়টি দেশ তা অর্জন করতে পেরেছিল। অথচ ২০২৪ সালে এসে এই সংখ্যাটি ২৩-এ দাঁড়িয়েছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সবগুলো ৩২ সদস্য দেশই এ লক্ষ্যে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু এবার ৫ শতাংশের এই নতুন ঘোষণা মূলত রাজনৈতিক কৌশলের ফসল। এর একটি অংশ আসছে “সৃজনশীল হিসাবনিকাশ” থেকে, যার মাধ্যমে সামরিক অবকাঠামোগত ব্যয়কেও সাধারণ উন্নয়ন খরচের আওতায় এনে গোনা হচ্ছে। এভাবে ট্রাম্পের মতো চাপে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের খুশি রাখাই যেন মূল উদ্দেশ্য। যদিও এর মধ্যে ১.৫ শতাংশই অবকাঠামোগত খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে, পুরো ব্যবস্থাটাই মূলত সামরিক খরচকে ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
২০২৪ সালে নেটোর সামরিক ব্যয় ছিল ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার—যা গোটা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি। আর ২০৩০ সালের মধ্যে যদি সবাই ৩.৫ শতাংশের লক্ষ্যে পৌঁছায়, তাহলে ১৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এই সংখ্যা কল্পনা করাও কঠিন, কারণ এক ডলারের নোটে গুনলে এই অর্থের স্তম্ভ চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে চারবার! আর এই অর্থ দিয়ে চাইলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে এককালীন ১,৬৭৪ ডলার করে দেয়া যেত।
এই বিপুল অর্থ ব্যয় আসলে কোথা থেকে আসবে? স্পষ্টতই তা সমাজকল্যাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের খাত কেটেই তোলা হবে। যেখানে ইউরোপের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, এবং জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন – বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমায় রাখতে হাতে আছে মাত্র দুই বছর – সেখানে এমন খরচ এক ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেই মনে হচ্ছে।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এই বাস্তবতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তার ভাষায়, “৫ শতাংশ খরচে সম্মত হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে আমাদের ৩০০ বিলিয়ন ইউরো বাড়তি ব্যয় করতে হতো। সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাটছাঁট করেই।”
এ বাস্তবতায়, ইউরোপের একাধিক দেশ ইতোমধ্যে সমাজ ও পরিবেশ খাতে খরচ কমানোর পথে হাঁটছে। যুক্তরাজ্য গত ফেব্রুয়ারিতে বিদেশে সহায়তা খাতের বাজেট ০.৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে সামরিক খরচ মেটানোর জন্য, যদিও নির্বাচনের সময় তারা এর বিপরীত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সও একই পথে হেঁটেছে—২৫ থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত সাহায্য কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তো এর আগেই বিদেশি সাহায্য ও জলবায়ু কর্মসূচি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে এবং পেন্টাগনের জন্য প্রস্তাব করেছে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট।
ইউরোপ নিজেই তার সমাজকল্যাণ ও পরিবেশ-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে পিছিয়ে পড়ছে। ২০২৬ সালে “রিকভারি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফ্যাসিলিটি” শেষ হয়ে যাবে, যা ছিল এই খাতে মূল অর্থায়ন ব্যবস্থার একটি। ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (ETUC) বলছে, নেটোর সদস্যরা ৩.৫ শতাংশের লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে তাদের হয় সমাজ খাতে কাটছাঁট করতে হবে, না হয় কর বাড়াতে হবে, অথবা আর্থিক নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে।
এছাড়া, এ ধরনের খরচ শুধু সামাজিক খাতে নয়, জলবায়ুর উপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। নেটো ইতোমধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম বড় কার্বন নিঃসরণকারী হিসেবে পরিচিত। তারা আরও বেশি জ্বালানিনির্ভর যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় বিনিয়োগ করছে। এক গবেষণা বলছে, যদি নেটো ৩.৫ শতাংশ GDP খরচ করে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা ২৩০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে – যা ব্রাজিল ও জাপানের মিলিত বার্ষিক নিঃসরণের সমান।
নেটোর যুক্তি হলো, “রাশিয়া” ও “সন্ত্রাসবাদের” হুমকি মোকাবেলায় এই বাড়তি খরচ দরকার। কিন্তু বাস্তবে ৫ শতাংশ টার্গেটের পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ বা বিশ্লেষণ নেই। এমনকি নেটোর কিছু কার্যক্রমই যে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পথ তৈরি করেছে, সেই আত্মসমালোচনার অভাবও চোখে পড়ে। রাশিয়া সামরিক খরচ বাড়ালেও, তাদের অর্থনীতি মাত্র ২ ট্রিলিয়ন ডলার, যেখানে শুধু নেটোর মার্কিন অংশ ২৯ ট্রিলিয়ন ডলারের এবং বাকিদের সম্মিলিত GDP ২৬ ট্রিলিয়ন। ফলে তারা কখনোই সামরিক খাতে নেটোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না।
আর “সন্ত্রাসবাদের” হুমকির কথা বললে, তা রোধে সামরিক খরচ বাড়ানোর নীতিও প্রশ্নবিদ্ধ। আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় নেটোর সামরিক হস্তক্ষেপ বিপরীত ফলই এনে দিয়েছে – সেখানে অস্থিরতা বাড়িয়েছে, এবং নতুন যোদ্ধা তৈরির পথ তৈরি করেছে।
সব মিলিয়ে, নেটোর এই ব্যয়বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত যতটা না নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তার চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি করে – সমাজ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই এক বিপর্যয় ডেকে আনছে।
আপনার মতামত জানানঃ