‘বোরিং’। কথাটা ইংরাজি হলেও, একঘেয়ে কিংবা বিরক্তিকর বোঝাতে কথায়-কথায় আমরা ব্যবহার করে থাকি এই শব্দবন্ধটি। অপছন্দের খাবার, জায়গা কিংবা কাজের আগে হামেশাই ‘বোরিং’ শব্দটি জুড়ে দিই আমরা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ‘বোরিং’ সংখ্যা (Most Boring Number) কোনটি?
ঘাবড়ে গেলেন নিশ্চয়ই? বেশ, তাহলে আরেকটু সহজ করে দেওয়া যাক প্রশ্নটা। আপনার সবচেয়ে প্রিয় সংখ্যা কোনটি? এক্ষেত্রে কেউ বেছে নিতে পারেন লিও মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জার্সি সংখ্যাকে, কেউ আবার আশ্রয় নিতে পারেন এমন কোনো সংখ্যার যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে কোনো ধার্মিক তত্ত্ব বা কিংবদন্তি। যেমন, লোককথা অনুযায়ী ১৩ সংখ্যাটি নাকি দুর্ভাগ্যের প্রতীক, ৭ সংখ্যাটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে পাপ। কিন্তু একজন সংখ্যাতাত্ত্বিকের চোখে সবচেয়ে ‘বোরিং’ সংখ্যা কোনটি?
একটা কাহিনি দিয়েই শুরু করা যাক এই প্রশ্নের অনুসন্ধান। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক সহকর্মীকে দেখতে যাবেন বলে ট্যাক্সি নিয়েছিলেন কিংবদন্তি গণিতবিদ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি। সে-সময় তাঁর নজর কেড়েছিল ট্যাক্সির নাম্বার প্লেটে থাকা একটি সংখ্যা— ১৭২৯। মিনিট তিরিশের যাত্রাপথ।
আর এই অবসর সময় কাটাতেই সংখ্যাটা নিয়ে কাটা-ছেঁড়া শুরু করেছিলেন হার্ডি। তবে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। হাসপাতালে পৌঁছে অসুস্থ সহকর্মীর কাছে মজার ছলেই এই ‘বোরিং সংখ্যা’-টির কথা বলে ফেলেছিলেন তিনি। তবে উল্টোদিকের মানুষটির উত্তর রীতিমতো চমকে দেয় তাঁকে।
১৭২৯ সংখ্যাটি আদতে মোটেই ‘বোরিং’ নয়। তার কারণ, ১৭২৯ এমন একটি সংখ্যা, যাকে দুটি ভিন্ন ভিন্নভাবে দুটি সংখ্যার ঘন অর্থাৎ কিউবের যোগ হিসাবে প্রকাশ করা যায়। যেমন, ৯৩ + ১০৩ = ১৭২৯, আবার ১২৩ + ১৩= ১৭২৯। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই বিশেষ সিরিজের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংখ্যাই হল ১৭২৯।
এই গল্প বলার কারণ হল, সামান্য এই ঘটনা থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে ‘বোরিং সংখ্যা’ খুঁজে বার করার গবেষণা শুরু করেছিলেন হার্ডি। পরবর্তীকালে সেই ধারা বজায় রেখেছেন তাঁর উত্তরসূরিরাও। আর তাঁর সেই অসুস্থ সহকর্মী? তিনি আর কেউ নন, কিংবদন্তি ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন। ১৯২০ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। এই প্রকাণ্ড কর্মযজ্ঞে আর সামিল হওয়া ওঠেনি তাঁর।
এবার এই ঐতিহাসিক কাহিনি ছেড়ে ডুব দেওয়া যাক বিজ্ঞানের জগতে। রামানুজনের কথা শুনেই বিভিন্ন সংখ্যার সিরিজ তৈরি করা শুরু করেন হার্ডি। উদাহরণ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে ৩ কিংবা ৫-এর গুণিতকের সিরিজ, বর্গসংখ্যা, ঘনসংখ্যা, মৌলিক সংখ্যার সিরিজ। তাছাড়া ফিবোনাকি সিরিজ, লেগো ব্লক, লেজি কার্টার সিকোয়েন্সের মতো বিষয় তো রয়েছেই।
সবমিলিয়ে এ ধরনের ২ হাজারেরও বেশি সিরিজ তৈরি করেন হার্ডি। আর সেই সিরিজে যে-সমস্ত সংখ্যা কোনোভাবেই হাজির হচ্ছে না, তাদেরকে বাছাই করে সরিয়ে রাখেন ‘বোরিং নাম্বার’ হিসাবে।
হার্ডির এই কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান আরেক কিংবদন্তি গণিতজ্ঞ নিল স্লোয়েন। ১৯৬৩ সালে থিসিস রচনার সময় এই ধরনের আরও ২৪০০টি সিকোয়েন্স তৈরি করেন তিনি। প্রতিটি সিকোয়েন্স বা সিরিজের মধ্যে নির্দিষ্ট সম্পর্কও তৈরি করেছিলেন স্লোয়েন। সঙ্গে তিনি এও জানিয়েছিলেন, সংখ্যাতত্ত্বের এই বিপুল সমুদ্রভাণ্ডার ঘেঁটে ‘স্পেশাল’ সংখ্যাদের পৃথক করা কারোর একার পক্ষে সম্ভব নয়।
স্লোয়েনের এই কথাকে বেদবাক্য করেই ১৯৯৬ সালে সংখ্যাতত্ত্বের একটি ডিজিটাল অর্থাৎ অনলাইন এনস্লাইক্লোপিডিয়া গড়ে তোলেন সংখ্যাবিদ সাইমন প্লুফ। সাইমন নিজেও তৈরি করেছিলেন এ-ধরনের বেশ কিছু সিরিজ। সঙ্গে স্লোয়েন এবং হার্ডির তৈরি সিকোয়েন্সও তিনি সংরক্ষণ করেন এই ওয়েবসাইটে।
পাশাপাশি দরজা খুলে দেন সাধারণ মানুষের জন্য। যে-কেউই বিশেষ বিশেষ গাণিতিক সম্পর্কের ব্যবহারে এ-ধরনের সিরিজ তৈরি করে জমা দিতে পারেন সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে। তারপর তা গবেষকরা যাচাই করেই প্রকাশ করেন এই ডিজিটাল এনসাইক্লোপিডিয়ায়।
গত আড়াই দশকে এই ওয়েবসাইটে মোট সিকোয়েন্সের সংখ্যা ৫৫০০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লক্ষ ৬০ হাজারে। আশ্চর্য সব সিকোয়েন্স তৈরি করে জমা দিয়েছেন ১৩০০-র বেশি মানুষ। বছর কয়েক আগে, এই এনসাইক্লোপিডিয়ায় নথিভুক্ত সংখ্যাগুলিকে নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেন ফরাসি গণিতবিদ ফিলিপ গুগলিয়েলমেট্টি।
কোন সংখ্যাগুলি সবচেয়ে বেশিবার এসেছে নানা সিকোয়েন্সে আর কোনগুলি সবচেয়ে কমবার— তা বাছাই করতেই এই প্রচেষ্টা। আর সেটা করতে গিয়েই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ‘বোরিং’ সংখ্যাটিকে চিহ্নিত করেন তিনি।
গুগলিয়েলমেট্টির তৈরি পরিসংখ্যানের গ্রাফ তথা ফ্রিকোয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশন অনুযায়ী, যে-সব সংখ্যা ৩০০ বা তার বেশিবার বিভিন্ন সিরিজে বা সিকোয়েন্সে ধরা দিয়েছে, সেগুলি আকর্ষণীয় কিংবা মজার সংখ্যা। অন্যদিকে যেগুলি ৩০০-র কম বা দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সিরিজে সেগুলি আপাতভাবে বোরিং।
আর এই ডিস্ট্রিবিউশন থেকেই উঠে আসে, সমগ্র ওয়েবসাইটে সবচেয়ে কম বার ব্যবহৃত হয়েছে ‘২০০৬৭’ সংখ্যাটি। গোটা ডেটাবেস বা তথ্যভাণ্ডারজুড়ে এই সংখ্যাটি আবর্তিত হয়েছে মাত্র ৬ বার। কাজেই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ‘বোরিং’ সংখ্যা হিসাবে ধরে নেওয়া যায় এটিকেই।
এখানেই শেষ হতে পারত এই প্রতিবেদন। তবে ‘১৭২৯’ সংখ্যাটির ব্যাপারে খানিক না বললে চলে না। প্রাথমিকভাবে যে সংখ্যা দিয়ে এই গোটা কর্মকাণ্ডের সূচনা, যাকে সর্বপ্রথম ‘বোরিং’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন হার্ডি, সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী তা মোটেও বোরিং নয়। বরং, গোটা তথ্যভাণ্ডারে সংখ্যাটি বিভিন্ন সিকোয়েন্সে ব্যবহৃত হয়েছে ৯৭৩ বার। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘২০০৬৭’ সংখ্যাটিও ভবিষ্যতে ‘বোরিং’ তকমা মুছে ফেলতে পারে— সেই সম্ভাবনা রয়েছেই। সূত্র: প্রহর।
আপনার মতামত জানানঃ