বাংলাদেশের রাজধানী মেগাসিটি ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বায়ুমান সূচকে বিশ্বে বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত গড়ে ঢাকার অবস্থান প্রথম স্থানে ছিল এবং দূষণের মাত্রা গড়ে ৫০২ পর্যন্ত উঠেছিল। তবে দুপুর ১টার পরে কিছুটা কমে ২২১-এ এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তারপরও ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। ১১ জানুয়ারি সোমবারও সূচক কিছুটা কম থাকলেও ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্বের শীর্ষস্থানে ছিল।
গত সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত শীর্ষে থাকা ঢাকার বায়ুদূষণের সূচক ছিল ৪২৭। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পাকিস্তানের লাহোর ২০২, তৃতীয় ছিল ভারতের কলকাতা-১৯১, চতুর্থ ছিলো নেপালের কাঠমুন্ড-১৮৫, পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি-১৭৮। এভাবে ১২তম অবস্থানে আছে চীনের সাংহাই।
পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, সেগুলোর তালিকার একদম শীর্ষের কাছাকাছি স্থানে থাকে বাংলাদেশের ঢাকা। কখনো কখনো ভারতের দিল্লি সবার ওপরে, ঢাকা ঠিক তার পরেই থাকে। আবার কখনো ঢাকা দিল্লিকেও ছাড়িয়ে যায়। গত বছর ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শহরগুলোর শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশের ঢাকা সেগুলোর অন্যতম। আর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশর অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছে।
শুধুমাত্র ঢাকায় প্রতিবছর প্রায় ২৬ হাজার লোক মারা যায় বায়ুদূষণজনিত রোগে। শহরের মধ্যে মেট্রোরেল সহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলার কারণে বর্তমানে বায়ুদূষণে শীর্ষে অবস্থার করছে ঢাকা। এছাড়াও বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিশেষত শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার দুই–তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদ্রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যানসার হয়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব প্রকট।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এত দিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে জাপানের টোকিও শহর। প্রতিবেদনটিতে মূলত কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পিএম ২.৫ ছাড়াও বায়ুর অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে সামগ্রিক দূষণের একটি চিত্র ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল।
অন্য একটি গবেষণা মতে, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের জন্য ইটভাটা দায়ী, ১৮ শতাংশের জন্য দায়ী রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট, ১০ শতাংশের জন্য যানবাহনের পোড়া ধোঁয়া এবং ৮ শতাংশের জন্য দায়ী বায়োমাস পোড়ানো। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ কারণে শুধু ঢাকাতেই এক বছরে ২৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর। বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগস্ত হচ্ছে শিশু, রোগী আর বৃদ্ধরা। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরের ছয় লাখ মানুষ এখন সিসাদূষণের কবলে। ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার।
ঢাকার বায়ুদূষণ বিষয়ে বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকার একটি গণমাধ্যমকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে। কারণ করোনকালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ ছিল। তখন ঢাকা শহরের দূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এখন একসঙ্গে সব উন্নয়ন কর্মকান্ড শুরু হওয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এভাবে একধারে তিনদিন একই অবস্থা থাকলে দূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার নিয়ম রয়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে দুই বেলা পানি ছিটালে বায়ুদূষণের ২০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব্য। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
ঢাকার দৈনিক সংবাদকে ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আবদুল্লাহপুর এলাকার। সেখানে ধুলাবালির কারণে সড়কের যানবাহন দেখা যায় না। ওই এলাকায় বিআরটি’র কাজ চলার কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। দূষণের মাত্রা অনেক বেশি এখন। এটা আরও ক’দিন এমনই থাকবে। বড় প্রকল্পের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়া, আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়াই মূলত দায়ী। এগুলো বন্ধ করে দ্রুত বড় রাস্তাগুলোতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা দরকার এখনই। নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভবতীদের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকতে হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে অনেকক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
এসডব্লিউ/নসদ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ