সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুনই জলমহলে জেলে শ্যামাচরণ বর্মণকে(৬৫) হত্যার ঘটনার ৬৩জনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে সুনই জলমহল সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও নিহতের ছেলে চন্দন বর্মণ (৩০)। সরকার সমর্থিত স্থানীয় সাংসদ ও সাংসদের ভাই উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য শ্যামাচরণ বর্মণকে (৬৫) হত্যা, সুনই জলমহালের খলাঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (৫২), তাঁর ছোট ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রোকন (৩২), সাংসদের বড় ভাই উপজেলা আওয়ামীলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মোবারক হোসেন মাসুদসহ (৫৫) ৬৩জনকে আসামী করে লিখিত অভিযোগটি দেয়া হয়।
এর পূর্বে গত বৃহস্পতিবার (০৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় উপজেলার সুনই জলমহালে জলমহল দখল নিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটে।
এদিকে, হত্যার ঘটনার পর শনিবার বিকালে সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সুনই জলমহাল পাড়ের সুনই গ্রামে গিয়ে বলেন পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন। তারা ন্যায় বিচারে সহায়তা করবেন বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, জেলার ধর্মপাশার পাইকুরাটি ইউনিয়নের সুনই জলমহালটি জেলা প্রশাসনের অধীন। বার্ষিক প্রায় ২৫ লাখ টাকা করে ছয় (বাংলা ১৪২২ থেকে ১৪২৭ সাল) বছরের জন্য এটি ইজারা পায় সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির সভাপতি চন্দন ইজারা মূল্য পরিশোধ করেন ও জলমহালটির পাড়ে বসবাসসহ অন্যান্য কাজের জন্য পাঁচটি ঘর তুলে তা রক্ষণাবেক্ষণ করেন। একই সমিতির সভাপতি দাবি করে সুবল বর্মণ (৩০) তিন মাস আগে ১৫-২০ জন লোক নিয়ে জলমহালটির পাড়ে দুটি ঘর তৈরি করেন এবং ১৪২৭ সালের জন্য এর ইজারা মূল্য পরিশোধ করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। তবে জলমহালটি নিয়ে উচ্চ আদালতে সমিতির দুটি মামলা থাকায় আদালতের নির্দেশে জলমহালটিতে স্থিতাবস্থা রয়েছে।
এর পর থেকেই উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। এরই জের ধরে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৭টায় দিকে দু’পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জলমহালের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এসময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শ্যামাচরণ বর্মণ নামের একজন মারা যায় ও উভয় পক্ষের ৩০জন আহত হন।
লিখিত অভিযোগে উল্লেখ্য করা হয়, সুনই জলমহল সমিতির পক্ষ থেকে ১৪২২ বঙ্গাব্দের ইজারা মূল্য পরিশোধ করলেও সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রোকন ও তাঁর ভাই মোবারকের সহায়তায় তাঁদের লাঠিয়াল বাহিনী জলমহালটি থেকে মাছ ধরে নেয়। সমিতির পক্ষে ১৪২৩ বঙ্গাব্দের খাজনা পরিশোধ করলে সাংসদসহ তাঁদের তিন ভাই জলমহালে মাছ ধরতে দেবেন না বলে সমিতির সদস্যদের হুমকি দেন। এ নিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করলেও লাভ হয়নি। চন্দন বর্মণের কাছে প্রতিবছর জলমহালটির ফিশিং বাবদ সাংসদ ১০লাখ টাকা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে লভ্যাংশের ৬ আনা দিতে বললে তিনি( চন্দন) রাজি হন।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার (০৭ ডিসেম্বর) রাত আটটার দিকে উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল ও তাঁর আরও দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ওই ৬৩ জন দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সুনই জলমহালের খলাঘরে ঢোকেন। এ সময় মোজাম্মেলের নির্দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সমিতির সদস্যসহ সেখানে থাকা নারী-পুরুষদের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করেন। তাঁরা সমিতির একটি খলাঘরে আগুন ধরিয়ে দেন ও ১০-১৫ মণ জাল আগুনে দেন। এ সময় বাধা দিলে তাঁরা সমিতির সদস্য শ্যামাচরণকে গলা কেটে হত্যা করেন।
এ বিষয়ে চন্দন বর্মণের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সমিতির সহসভাপতি ও নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই মনীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ (৫৫) বলেন, আমার ভাই শ্যামাচরণকে হত্যা, জলমহালের ঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এব্যাপারে পাইকুরহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ায়ম্যান মোঃ ফেরদৌস আলম জানান, এখানে সুবল বর্মন ও চন্দন বর্মন পৃথক দুটি সমিতি’র বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এ বিরোধের জের ধরেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে। ঘটনার দিন ও সময় উপজেলা চেয়ারম্যান সুনামগঞ্জে ও ডিসি অফিসে মতবিনিময় সভায় ছিলেন।
ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন রুকন বলেন, আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিং এ ছিলাম। পরে সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নির্বাচনে নৌকা সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ করি। ঘটনার সময় আমি এলাকায়ই ছিলাম না। আমি কোন ভাবেই এই ঘটনার সাথে জড়িত না। আমি নিজেও শ্যামা চরন বর্মন হত্যাকান্ডের জড়িতদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবী জানাই।
সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ঘটনার দিন আমি ধর্মপাশায় ছিলাম না। তাই আমার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না। হামলা, হত্যাকান্ডের ঘটনায় জডড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হোক এটা আমারও দাবী। তবে আমাকে ও আমার পরিবারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই ঘটনার সাথে জড়ানোর অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনায় শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার রাতেই সন্দেহজনক ২৩জনকে আটক করা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তাই বাকি ২১জনকে শুক্রবার (০৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের যাচাইয়ে ঘটনার দিন সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সুনামগঞ্জে ছিলেন। এরপরও তাকে অভিযুক্ত করে অভিযোগ দায়ের হওয়ায় মামলা গ্রহণে বিলম্বে হচ্ছে। যেহেতু সংসদ সদস্য ওখানে ছিলেন না, তাকে এভাবে আসামি করে মামলা গ্রহণ করলে যে কেউ যে কোনো সময় আসামি হয়ে যেতে পারে। এই বিষয়টি দেখছি আমরা।
এসডব্লিউ/জেএভি/নসদ/২২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ