অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ কাটেনি। যদিও গণ-অভ্যুত্থানের পর কর্মস্থল ছেড়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের কাজে ফিরিয়ে এনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়েছে বেশকিছু উদ্যোগ।
দুই দফায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বাহিনীটির শীর্ষ পদে। ঢেলে সাজানো হয়েছে থানা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও। তবে এতসব উদ্যোগের পরও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনো দৃশ্যমান নয়। বিশেষ করে একের পর এক মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটায় আতঙ্কিত পুলিশসহ সাধারণ জনগণ। আবার হেফাজতে মৃত্যু, অপহরণ, ছিনতাই ও পুলিশ আক্রান্তের ঘটনাও বেড়ে চলেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে খুন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে সর্বমোট ৫ হাজার ৮৬২টি। এর মধ্যে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ১৯২টি। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩২৯টি। খুনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৫৪৫টি। সেই সঙ্গে ছিনতাই ও চুরির মতো অপরাধও বেড়েছে এ সময়ে। এ সময়ের মধ্যে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ৩ হাজার ১৫৩ ও ৬২৩টি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সার্বিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলা। বিগত কয়েক মাসে খুনের ঘটনা কিছুটা কমে এলেও মব জাস্টিস, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও দখলের মতো অপরাধও বেড়েছে। মব জাস্টিসের নামে বিভিন্ন স্থানে হিংসাত্মক ঘটনা রোধে রাষ্ট্রের যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে নাগরিক নিরাপত্তায় দেখা দিয়েছে বড় ধরনের সংকট। এ অবস্থায় পুলিশকে আরো মনোযোগী হয়ে এসব অপরাধ দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পৌঁছতে পারেনি। বরং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশেষ করে মব জাস্টিস ও কাস্টোডিয়াল ডেথ প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। আদালতে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। মব জাস্টিসের নামে বিভিন্ন জায়গায় হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন সেটা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি এখন পর্যন্ত জুলাই-আগস্টের অপরাধীদেরও চিহ্নিত করা হয়নি। শহীদদেরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি এখনো।’
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর সবচেয়ে বেশি জনরোষের শিকার হয় পুলিশ সদস্য এবং তাদের স্থাপনাগুলো। পুলিশের হিসাবে আন্দোলন ঘিরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের ৪৬০টি থানা ও স্থাপনা। এর মধ্যে সংস্কার করা হয়েছে ১১৪টি থানা। ৫ আগস্টের আগে ও পরে বাহিনীটির ৫ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র লুট হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩১৭টি এখন পর্যন্ত উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ। আর লুট হওয়া গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে ৬০ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে দুই দফা পুলিশের শীর্ষ পদের পরিবর্তন এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও ঢেলে সাজানো হয়। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয় রাজধানী ঢাকায়। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। এরপরও পুনরুদ্ধার করা যায়নি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
এর মধ্যে আগস্টেই খুন হয় ৬১৮ জন, অপহরণের শিকার হয় ২৭ জন, চুরির ঘটনা ঘটে ৩৮১টি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭০টি ও পুলিশের ওপর হামলা হয় ৪১ বার। সেপ্টেম্বরে খুনের ঘটনা কমে ২৮৩-তে নামলেও অপহরণের ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫টিতে। পাশাপাশি এ সময়ে ৬০৫টি চুরি, ১০৪টি ছিনতাই ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে ২৪টি। অক্টোবরে ২৪৯ জন খুন, অপহরণের শিকার হন ৯৬ জন, চুরির ঘটনা ঘটে ৭২২টি, ছিনতাইয়ের শিকার হন ১৫৭ জন ও দায়িত্ব পালনকালে আক্রান্ত হন ৩৪ পুলিশ সদস্য। পরের মাস নভেম্বরে খুন হন ২১১ জন, অপহরণ হন ৬৭ জন, চুরির ঘটনা ঘটে ৭১৬টি, ছিনতাই ১৩৩টি ও পুলিশ আক্রান্তের ঘটনা ঘটে ৪৯টি। ডিসেম্বরে খুনের ঘটনা কিছুটা কমে আসে। ওই মাসে সারা দেশে খুন হন ২০৪ জন। অপহরণ হন ৭৪ জন, চুরির ঘটনা ঘটে ৭২৯টি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১৫৯টি এবং দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি।
জনবল ও লজিস্টিকের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে বলে জানালেন ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অল্প সময়ের মধ্যে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। আমরা চেষ্টা করছি জনবল ও লজিস্টিকের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে নগরবাসীকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বরং কীভাবে রাজধানীকে আরো নিরাপদ করে তোলা যায়, সে বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে।’
ক্রমাগত হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। মানবাধিকার কর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটা দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের পর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিগত সরকারের বিদায় হয়েছে। তারা পুলিশকে নিজেদের মতো করে অপব্যবহার করেছিল। যার কারণে পুলিশ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। সে পরিস্থিতি থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশ কাজে ফিরতে শুরু করে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে। তবে আমি মনে করি তাদের আরো মনোযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে যেন কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা অপরাধ সংঘটিত না হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেন না ঘটে। সবকিছু বিবেচনা করলে বলা যায়, এ অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা খুব খারাপ বা খুব ভালো ছিল, সেটা বলা যাবে না। তবে আরো ভালো করা উচিত বলে আমি করে করি। বিশেষ করে মানবাধিকার পরিস্থিতিতে পুলিশকে আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।’
তবে পুলিশ বলছে, স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর পর সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল অতিদ্রুত পুলিশের ইউনিটগুলোকে অপারেশনাল করা এবং জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়া। পুলিশ সদস্যরা পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ইউনিটগুলোকে দ্রুতই অপারেশনাল করেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের সাহস ও মনোবল অটুট রেখে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আপনার মতামত জানানঃ