ঢাকায় শনিবার বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যেভাবে গণতন্ত্র রক্ষায় দলের কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন তা সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।
বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ঢাকায় পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই সমাবেশের এক প্রস্তুতি সভায় বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, “প্রয়োজনে ২৮ অক্টোবর আমরা লগি-বৈঠা নিয়ে আবারও গণতন্ত্র রক্ষা করব।”
এসময় তিনি বলেন, “২৮ অক্টোবর (২০০৬ সাল) যেমন আমরা লগি-বৈঠা নিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলাম, তেমনি এই ২৮ তারিখও আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।”
সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে
“রাজনৈতিক দলগুলো এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যাতে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় এখন আমরা সহিংসতার খুব কাছাকাছি,” দুই দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ না খুঁজে দলগুলো নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার কারণেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “ক্ষমতাসীনরা যে ভাষায় কথা বলছে তাতে সহিংসতাকে আবশ্যিক করে ফেলা হচ্ছে। এটা খুবই ভয়াবহ ব্যাপার।”
এদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে ঘোষিত ২৮ অক্টোবর ঢাকা মহাসমাবেশের জন্য বিকল্প ভেন্যুর সন্ধান করতে পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
পুলিশের একই রকম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে একইদিন ঢাকায় ঘোষিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’ করার ঘোষণায় অনড় রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে জামায়াত ইসলামীকে সমাবেশের অনুমোদন দেয়া হবে না, সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা দেয়া হলেও দলটি বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, তারা ২৮ অক্টোবর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করবে।
বিএনপির সমাবেশ দলের নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, আওয়ামী লীগের সমাবেশ গুলিস্তান এলাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেইটে অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। এই ভেন্যুগুলোর অবস্থান দুই কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় ক্ষমতাসীনদের অব্যাহত হুমকি এবং ২০২৬ সালের একই দিনের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাতের বর্ষপূর্তি হওয়ায় পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
গ্রেপ্তার বাড়িয়েছে পুলিশ
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীদের নামে থাকা পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার ও রাতের বেলায় তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
“নেতাকর্মীদের মনে ভীতি সৃষ্টি করতে” সারাদেশে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্যে দেখা গেছে, দলটির মহাসমাবেশ ঘোষণা দেওয়ার পর গত সাত দিনে অন্তত ৮৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে বিএনপির আরও ১৫০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে রিজভী অভিযোগ করেন, মহাসমাবেশ সামনে রেখে পুলিশ সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার জোরদার করেছে।
এদিকে ২১ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ দিনে বিরোধী দলের অন্তত ৩১১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকার সিপাহীবাগ থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা ও নরসিংদী জেলায় একাধিক মামলায় ওয়ান্টেড থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান গোয়েন্দা শাখার মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার রাজিব আল মাসুদ।
মহাসমাবেশকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার সম্পর্কিত দলটির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের একজন মুখপাত্র বলেন, ফৌজদারি মামলার আসামি এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, এবং কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করে সেটি করা হচ্ছে না।
ঢাকার দারুরসসালাম এলাকা থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করে মোশাররফ হোসেন এক যুবককে। বৃহস্পতিবার তার স্ত্রী আসমা আক্তার ঢাকার আদালত পাড়ায় স্বামীর সন্ধানে হাজির হন।
সেখানে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তার অপরাধ হচ্ছে তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন।”
আসমার মতোই আরো অনেক স্বজনকে এদিন সকাল থেকেই ঢাকা জেলা ও মহানগর আদালতের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
বিএনপির অভিযোগ, নিরাপত্তার নামে মহাসড়কে ঢাকাগামী বাস থেকেও পুলিশ লোকদের আটক করেছে।
বিকল্প স্থানে যাবে না কেউই
সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলকেই তাদের প্রস্তাবিত ভেন্যুর বাইরে দুটি বিকল্প ভেন্যুর প্রস্তাব করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে দল দুটি।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদেরকে পুলিশ বিকল্প ভেন্যু চেয় যে চিঠি দিয়েছে তার জবাবে আমার জানিয়ে দিয়েছ পূর্ব নির্ধারিত স্থানেই সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ।” অপরদিকে পুলিশের চিঠির একই রকম জবাব দিয়েছে বিএনপিও।
দলটির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমকে বলেন, “পল্টন থানায় চিঠির মাধ্যমে আমরা পুলিশকে জানিয়েছি আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ নয়া পল্টন থেকে স্থানান্তর সম্ভব নয়।”
উত্তেজনা ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক বক্তৃতায়
বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শনিবার আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে হামলা হলে ‘পাল্টা হামলা’ করবে তার দল।
যদিও এখন পর্যন্ত কোনো বিরোধী দলই আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা করার কথা বলেনি, তবুও কাদের বলেন, “বিএনপি যদি গায়ে পড়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করতে আসে, …শান্তি সমাবেশে যদি হামলা হয়, তাহলে আমাদের কর্মীরা বসে থাকবে না। পাল্টা হামলা অবশ্যই হবে।”
ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, “বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে নিয়ে অহেতুক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা চায় দেশে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হোক।” সূত্র: বেনার।
আপনার মতামত জানানঃ