ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় খাবার ও পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে লাখ লাখ মানুষের। এক নারী জানিয়েছেন, তার ঘরে একটি পাউরুটির দুটি টুকরো ছাড়া আর কোনো খাবার অবশিষ্ট নেই। যে দুই-একটি খাবারের দোকান খোলা আছে সেগুলোতেও মানুষের দীর্ঘ সারি। সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও খাবার পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, ক্ষুধাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। পুরো দুনিয়ার চোখের সামনে লাখ লাখ মানুষকে সম্মিলিতভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এর কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
অক্সফামের বিবৃতিতে গাজায় খাবার, পানি, জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রবেশের অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতারা বসে থাকতে পারেন না। এ সংকট মোকাবেলায় তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
শুধু খাবার আর পানির সংকটই নয়, গাজায় প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গতকাল সারা দিন এবং তার আগের দিন রাতভর উপত্যকায় দফায় দফায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ)। এসব হামলায় স্বজন হারিয়েছে হাজারো মানুষ। কেউবা নিজের শিশুসন্তানকে হারিয়েছে, কোথাও আবার মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েছে শিশুরা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় অঞ্চলটিতে ৭৫৬ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ)। এর মধ্যে ৩৪৪টি শিশুও রয়েছে। ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর এটিই একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা। এ নিয়ে গত ১৯ দিনে গাজায় ৬ হাজার ৫৪৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৪টিই শিশু। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৭ হাজার ৪৩৯ জন।
কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরাহমান বিন জসিম আল থানি বলেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধে যে পরিমাণ শিশু মারা গেছে তার চেয়ে বেশি শিশু নিহত হয়েছে গাজা উপত্যকায়। অথচ ইউক্রেনের ক্ষেত্রে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল গাজার ক্ষেত্রে সেটি দেখা যাচ্ছে না।’ এর আগে গত মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন আচরণ করছি যেন ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবনের কোনো দাম নেই, তারা যেন নাম-পরিচয়হীন।’
গাজার একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বিমান হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের শরীরে আঘাতের যে চিহ্ন দেখা যাচ্ছে তা আগের চেয়ে আলাদা। অর্থাৎ, অঞ্চলটিতে নতুন ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরায়েলি বাহিনী। পশ্চিম তীরেও হামলা চালাচ্ছে আইডিএফ। গত রাতে পশ্চিম তীরের একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। এছাড়া দখলকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে ৮০ ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
৮ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। ফলে অঞ্চলটিতে খাবার, পানি, ওষুধ, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যুৎবিহীন উপত্যকায় জ্বালানি সংকটে কোনো রকমে টিকে থাকা হাসপাতালগুলোও বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ১২টি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ৭২টি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকের ৪৬টিই বন্ধ রয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় ভবনের ক্ষয়ক্ষতি, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের হতাহতের ঘটনা, চিকিৎসাসামগ্রী ও জ্বালানি সংকটে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
গাজায় বিশুদ্ধ খাবার পানিও প্রায় ‘শেষ’ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় লোকজন নোংরা পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ভিসা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। কোনো কারণ ছাড়াই ইসরায়েলে হামলা চালায়নি হামাস—সংস্থাটির মহাসচিবের এমন মন্তব্যের একদিনের মাথায় গতকাল এমন ঘোষণা দিয়েছে তেল আবিব। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান দেশটির আর্মি রেডিওকে বলেন, ‘তার (জাতিসংঘ মহাসচিব) এসব মন্তব্যের কারণে আমরা জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের ভিসা দেব না। এরই মধ্যে জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণবিষয়ক সমন্বয়ক মার্টিন গ্রিফিথসের ভিসা আবেদন বাতিল করেছি। তাদের শিক্ষা দেয়ার সময় এসেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশেই ইসরায়েল গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। গতকাল তেহরানে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমেরিকানদের হাত নিপীড়িত, শিশু, রোগী, নারী ও অন্যদের রক্তে রঞ্জিত।’ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বলেছেন, ‘হামাস কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। এটি মুক্তিকামী একটি মুজাহিদিন গোষ্ঠী, যারা নিজেদের ভূখণ্ড ও জনগণের সুরক্ষার জন্য লড়াই করছে।’ নিজ দল একে পার্টির আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে গতকাল দেয়া এক বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তির জন্য মুসলিম দেশগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ইসরায়েল সফর করে দেশটির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তবে ব্রিটিশ সরকারের এমন অবস্থানের সমালোচনা করেছেন স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার হামজা ইউসুফ। সরকারের প্রতি তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘গাজায় আর কত শিশুকে জীবন দিতে হবে?’
আপনার মতামত জানানঃ