হামাস-ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে এই অঞ্চলে ছয়টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঠানো যুদ্ধ জাহাজের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী যুদ্ধ জাহাজ জিবোও রয়েছে। এর আগে গত শনিবার (১৪ অক্টোবর) চীনা সেনাবাহিনীর এসব যুদ্ধ জাহাজ অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে মাস্কাট উপকূল ছেড়ে যায়।
চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, এসব যুদ্ধ জাহাজ গত বুধবার (১৮ অক্টোবর) পাঁচ দিনের সফরে কুয়েতের শুওয়াইখ বন্দরে নোঙর করেছে। নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে এসব যুদ্ধ জাহাজ কুয়েতে অবস্থান করছে।
ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে উত্তেজনা চরমে। ইসরায়েলের সহায়তায় এরই মধ্যে সেখানে দুটি অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরী ও দুই হাজার নৌসেনা মোতায়ের করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন সহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েল থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে সামরিক বা বেসামরিক বিমান পাঠিয়েছে। অন্যদিকে চীন বিমান না পাঠালেও নাগরিকদের বাণিজ্যিক ফ্লাইট ধরে ইসরায়েল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা পেরিয়ে অঞ্চলটির অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কার কথা বেশ জোর দিয়েই। এমন উত্তেজনাকর পরিস্তিতির মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে এসব যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করল চীন সরকার।
১৭ দিনে নিহত ২০০০ শিশু নিহত
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার লড়াই ১৮তম দিনে গড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বিপুল পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছে। সংখ্যার বিচারে তা ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ৫ হাজার। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার মাধ্যমে নির্বিচারে শিশু হত্যা করা হচ্ছে। বিগত ১৭ দিনে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২ হাজার ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর সকালে ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা শুরু করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তারা মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলের দিকে ৫ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। একই সঙ্গে স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথে দেশটিতে ঢুকে পড়েন হামাস যোদ্ধারা। হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। এখনো অনেকে হামাসের কাছে বন্দী আছে।
ইসরায়েলও এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘোষণা করে হামাসের বিরুদ্ধে। এর পর থেকেই দফায় দফায় গাজায় বিমান ও স্থল, এমনকি নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেই থেকে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অনবরত অবরুদ্ধ গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় নিহতদের প্রায় শতভাগই বেসামরিক নাগরিক। তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল সেই আহ্বান থোড়াই কেয়ার করে অবরুদ্ধ গাজায় হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী দিনে গাজায় বিমান হামলার পাশাপাশি বহুমুখী হামলা চালানো হবে। ইসরায়েলি অবরোধ ও হামলায় আক্ষরিক অর্থেই স্থবির হয়ে পড়েছে গাজা স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ফুরিয়ে গেছে সব ধরনের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম।
সেভ দ্য চিলড্রেন গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলার কারণে গাজায় অন্তত ১০ লাখের বেশি শিশু স্রেফ ‘ফাঁদে’ পড়ে গেছে; যাদের যাওয়ার কোনো নিরাপদ জায়গা নেই, বিদ্যুৎ নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই, কিচ্ছু নেই। আছে কেবল মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ।
ইসরায়েলি বোমা হামলায় বিপুল পরিমাণ শিশুর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বলে উঠে এসেছে সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক এই সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিগত ১৭ দিনের যুদ্ধে গাজায় অন্তত ২ হাজার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আরও ২৭ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে পশ্চিম তীরে।’
যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শিশুদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেই প্রচেষ্টার অংশীদার হয়ে সহায়তা করার আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি বিমান হামলা গাজায় নির্বিচারে শিশু হত্যা করছে।
যে শর্তে যুদ্ধ বন্ধে রাজি ইসরায়েল
গাজায় শুরু হতে যাওয়া স্থল অভিযান এমনকি যুদ্ধ বাতিল করা হবে কেবল দুটি শর্তে। প্রথমটি হলো, গাজায় হামাসের জিম্মায় থাকা বস বন্দীদের মুক্তি ও বিনা শর্তে হামাসের অস্ত্র সমর্পণ। ইসরায়েলির সশস্ত্র বাহিনীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাস অস্ট্রেলিয়ার এবিসি রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন।
সৌদি আরবের রিয়াদভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-আরাবিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, গাজায় ইসরায়েলি স্থল অভিযান অবশ্যম্ভাবী কি না। জবাবে কনরিকাস বলেন, ‘এখানে আমাদের লক্ষ্য হলো হামাসের সামরিক সক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা। এটি যদি বিমান হামলার মাধ্যমে এবং আমাদের সৈন্যদের খুব সীমিত ব্যবহারের মাধ্যমে করা যায়, তাহলে খুবই ভালো। পাশাপাশি কম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি স্থিতাবস্থা তৈরি করা গেলে তবে এটি দুর্দান্ত বিষয়।’
কনরিকাস আরও বলেন, ‘যদি হামাস লুকিয়ে থেকে, তাদের হাতে জিম্মি ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের মুক্তি না দেয়, তারা এখন যেমনটা করছে, তাহলে সম্ভবত আমাদের ভেতরে যেতে হবে এবং অভিযান সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের কথা হলো, আমাদের ২১২ জন জিম্মিকে ফিরিয়ে দাও, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করো, তাহলে যুদ্ধ শেষ হবে।’
ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীর এই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিতে এই যুদ্ধের শেষ অবস্থানটা হবে এমন, হামাস ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে এবং তারা আর কখনোই কোনো ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে না এবং অবশ্যই ৭ অক্টোবর তারা যে ধরনের ভয়ংকর আক্রমণ করেছিল, তা করার ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেওয়া। এটিই আমাদের লক্ষ্য।’
এদিকে আরও দুই জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। মুক্তি পাওয়া দুজনই ইসরায়েলি নারী। গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। ওই দুই জিম্মির মুক্তির পরও দক্ষিণ গাজায় রাতভর ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ৫৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক।
আপনার মতামত জানানঃ