সুমিত রায়
গত সপ্তাহটি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি ভাল সপ্তাহ ছিল, পাশাপাশি বহুল ঘৃণ্য ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের মৃত্যুও ছিল সেই সপ্তাহে। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের সৈন্যরা জাপারিজিয়ায় রাশিয়ার তিনটি প্রতিরক্ষামূলক লাইনের প্রথমটি ভেঙে রোবটাইন শহরও দখল করে নেয়। তবে ইউক্রেন রাশিয়াকে খুব শীঘ্রই নকআউট ব্লো দেবে – এমনটা হবার সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে, এবং কোনও পক্ষই শান্তিতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। তাই অনেক বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন যে ইউক্রেন এখন তথাকথিত দীর্ঘ যুদ্ধ বা লং ওয়ারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই লেখায় আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে কী ঘটছে তা দেখতে যাচ্ছি, কেন এর এখন একটি দীর্ঘ যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং কেন একটি দীর্ঘ যুদ্ধের সম্ভাবনা ইউক্রেনকে একটি কঠিন ডিলেমায় ফেলে দেয় তা নিয়ে আলোচনা হবে।
গত দেড় মাসের ঘটনা একটু আলোচনা করে নেয়া যাক। সব মিলে এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ইউক্রেনীয়রা জাপারিজিয়া ওব্লাস্টের দক্ষিণে আরও অগ্রগতি করেছে এবং রাশিয়ানদেরকে পূর্বদিকে কিছুটা ঠেলে দেয়া হয়েছে, তারা কোপিয়ানস্কের দিকে অগ্রসর হয়েছে। গত সপ্তাহের শুরুতে, ইউক্রেনীয়রা ইউক্রেনীয় শহর ওরিসিয়েভ থেকে রাশিয়ান অধিকৃত শহর তোকমাক যাওয়ার পথে টি০৪০৮-এ অবস্থিত একটি ছোট শহর রোবটাইন দখল করে নেয়, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি রেল কেন্দ্র, যেখান থেকে দক্ষিণে রাশিয়ান সৈন্য সরবরাহ করা হয়। রোবটাইন তোকমাক থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, তবে ইউক্রেনীয়দের ওরিসিয়েভ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অগ্রসর হতে দুই মাস সময় লেগেছে। এবং এটি কমপক্ষে তিনটি প্রতিরক্ষামূলক লাইনের মধ্যে প্রথম।
এখন স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আমি বলছি না যে ইউক্রেন টোকমাক পুনরুদ্ধার করবে না। ইউক্রেন নির্ভরযোগ্যভাবে প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে, এবং এটি সম্ভব যে রাশিয়ার পরবর্তী প্রতিরক্ষামূলক লাইনগুলি প্রথমটির মতো দুর্ভেদ্য হবে না। তবে আমাদের সম্ভবত শীঘ্রই এটি ঘটবে বলে আশা করা উচিত নয়, অন্তত এই কারণে যে ইউক্রেনে বৃষ্টি এবং কাদার সময় শুরু হওয়ার প্রায় এক মাস বাকি রয়েছে। পূর্ব দিকে রাশিয়ানরা কোপিয়ানস্কের দিকে সামান্য অগ্রগতি করেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, রাশিয়ানরা রাশিয়ার ওরোজোভো শহর থেকে কোপিয়ানস্ক পর্যন্ত রেল লাইন ধরে দক্ষিণে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে খুব কম সাফল্য পেয়েছে। তবুও, এটির উপর নজর রাখা উচিত কারণ এটি আমাদের রাশিয়ার আক্রমণাত্মক সক্ষমতা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেবে, যা বেশ কিছু সময় ধরে ইউক্রেনীয়দের ধারণার বাইরে।
রোবটাইনে ইউক্রেনের সাফল্য সত্ত্বেও, মনে হচ্ছে সামনের লাইনগুলি কিছুটা স্থিতিশীল হচ্ছে এবং উভয় পক্ষের অগ্রগতির হার স্পষ্টভাবে হ্রাস পাচ্ছে। রাশিয়ানরা প্রতিরক্ষামূলক ফর্টিফিকেশন প্রস্তুত করতে এবং আশেপাশের ক্ষেত্রগুলিতে খনন করার জন্য অনেক মাস সময় পেয়েছে, যার ফলে এখানে দ্রুত সম্মিলিত অস্ত্র আক্রমণ কঠিন হয়ে যায়। এবং ইউক্রেনের কার্যকরভাবে রাশিয়ান বাহিনীকে সরানোর মতো প্রযুক্তি বা অ্যামো নেই। খুব শিগগিরই এর কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না। পশ্চিমারা ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং এমো সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে ঠিকই, কিন্তু মুশকিল হলো ইউক্রেনের এগুলো খরচ করার হার আরো বেশি, বিশেষত যখন সোভিয়েত আমলের ১৫৫ মিমি আর্টিলারি শেলের কথা আসে। আর এফ-১৬-এর মতো আরও উন্নত পশ্চিমা প্রযুক্তি অন্তত এক বছরের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম।
পাল্টা আক্রমণের গতি ধীর হওয়ার সাথে সাথে ইউক্রেইনকে সহায়তা দেয়া লোকেরা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে, এবং ইউক্রেনীয় ও ইউক্রেনের কৌশলের সমালোচনাকারী পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তারা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ইউক্রেন দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবস্থার দিকে মনোনিবেশ করে ভুল করছে এবং গত মাসে জার্মানির বুন্দেসওয়ারের ফাঁস হওয়া যুদ্ধক্ষেত্রের মূল্যায়নে ন্যাটো প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন না করার জন্য ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে দোষারোপ করা হয়েছে। ইউক্রেনীয়রা পশ্চিমাদের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থা আটকে রাখার জন্য তাদের দোষারোপ করে এবং জোর দিয়ে বলে যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের কারণে ইউক্রেইনের পক্ষে দ্রুত সম্মিলিত অস্ত্র আক্রমণ (rapid combined arms offensives) অসম্ভব।
যদিও ইউক্রেনের এই অগ্রগতির হার স্পষ্টতই কিছু কমেন্টেটরকে হতাশ করেছে, এবং জেলেনস্কি নিজেই এই মাসে স্বীকার করেছেন যে এই অগ্রগতি সম্ভবত কিছু লোকের ইচ্ছার চেয়ে ধীর গতিতে ঘটছে, এটি সম্ভবত কারণ খার্কিভ এবং খেরসনে ইউক্রেনের দ্রুত সাফল্য এদের প্রত্যাশাকে অনেক বেশি উচ্চ করে তুলেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেক্সি রেজনিকভ কয়েক মাস আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ইউক্রেনের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণকে ঘিরে প্রত্যাশা অবশ্যই অত্যধিক উত্তপ্ত হয়েছে। এবং ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে তাদের সাফল্যের ভবিষ্যদ্বাণী কমিয়ে বলার জন্য অনুরোধ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ডিসকর্ড ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পেন্টাগন ইতিমধ্যে সতর্ক করেছিল যে কাউন্টার-অফেন্সিভটি “তার ঘোষিত লক্ষ্যগুলির চেয়ে অনেক কম” দিতে পারে।
তবুও, অনেক বিশ্লেষক এখন বিশ্বাস করেন যে ইউক্রেন একটি নির্ণায়ক আঘাত বা ডিসিসিভ ব্লো দিতে সক্ষম হয়নি – এর অর্থ হ’ল যুদ্ধটির এখন একটি দীর্ঘ যুদ্ধ বা লং ওয়ারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, যা কমপক্ষে আরও কয়েক বছর স্থায়ী হবে। কিছু আশা ছিল যে একটি সফল পাল্টা আক্রমণ ক্রেমলিনকে জেলেনস্কির শর্তে আলোচনা করতে বাধ্য করবে, তবে এখন শান্তি আলোচনা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেন ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধার সহ বেশ কয়েকটি সর্বাধিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং জেলেনস্কি পূর্বশর্ত হিসাবে ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে সমস্ত রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের উপর জোর দিয়েছেন, যা ঘটতে যাচ্ছে না। একইভাবে, ক্রেমলিনের বর্তমানে শান্তি আলোচনায় কোনও আগ্রহ নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে আলোচনার সম্ভাবনা নেই এবং রাশিয়া আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করে বলে যে, শান্তির আহ্বান সময় কেনার কৌশল মাত্র। ল্যাভরভ আরও মন্তব্য করেছেন যে, মিত্রদের সমর্থন করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড বা ইতিহাস ভালোনা।
ক্রেমলিন স্পষ্টতই একটি দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, এ কারণেই তারা সামরিক ব্যয় দ্বিগুণ করেছে, আরেকটি সেনা-সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ইউক্রেনকে তার শস্য রফতানি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে ইউক্রেনের বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ হ্রাস করার চেষ্টা শুরু করেছে। সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যদি একটি দীর্ঘ যুদ্ধে পরিণত হয়, তাহলে কার উপকার হবে? ওয়েল, যদিও সম্মিলিত পশ্চিমাদের স্পষ্টতই রাশিয়াকে পরাস্ত করার রিসোর্স রয়েছে, পুতিন আশা করবেন যে পশ্চিমারা ইউক্রেনের জন্য ধৈর্য এবং উৎসাহ না হারানো পর্যন্ত তা ব্যবহার করা হবেনা। সর্বোপরি, ক্রেমলিনের জন্য রাজনৈতিকভাবে আরও সংগঠিত হওয়া কঠিন হলেও, রাশিয়ার ইউক্রেনের চেয়ে বেশি অর্থ, বৃহত্তর শিল্প ভিত্তি এবং বৃহত্তর জনসংখ্যা রয়েছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হবে ২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, কারণ ট্রাম্প যদি রিপাবলিকান প্রার্থী হয়ে জয়ী হন, তবে ইউক্রেনের জন্য আমেরিকান সমর্থন আর নিশ্চিত নয়, অন্তত বর্তমানে যেরূপে সমর্থন দেয়া হচ্ছে সেরূপে নয়। এখন প্রথম কথা হচ্ছে, ট্রাম্প ইউক্রেনকে সমর্থন করা বন্ধ করবেন না। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বলেছিলেন যে পুতিন যদি শান্তিতে রাজি না হন তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে সমর্থন বাড়িয়ে তুলবেন। তিনি বলছেন, “আমি জেলিনস্কিকে বলব, আর কিছু না, আপনাকে একটি চুক্তি করতে হবে। আমি পুতিনকে বলব, আপনি যদি কোনো চুক্তি না করেন, তাহলে আমরা তাদের অনেক কিছু দেব, আমরা তাদের আগের চেয়ে বেশি দেব। যদি আমাদের প্রয়োজন হয়, আমি একদিনের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন করব।” তবুও, কমপক্ষে একটি ঝুঁকি রয়েছে যে ট্রাম্প সমর্থন হ্রাস করবেন, বিশেষত রিপাবলিকানদের মধ্যে ইউক্রেন বিরোধী মনোভাবের কারণে। যদিও বাইডেন স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি ইউক্রেনকে যতদিন সময় লাগবে ততদিন সমর্থন করতে চান, এ কারণেই তিনি সেনাবাহিনীকে ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১৫৫ মিলিমিটার সেল উৎপাদন শুরু করতে বলেছেন।
শেষ পর্যন্ত, এটি ইউক্রেনের হাই কমান্ডকে একটি কঠিন ডিলেমায় ফেলে দেয়। তারা হয় তাদের সব সৈন্যকে একটি ফ্রন্টে নিক্ষেপ করে এবং সম্ভবত আরও বেশি সৈন্য মোতায়েন করে রাশিয়ার উপর একটি বিশাল আক্রমণ চালাতে পারে, অথবা তার অবশিষ্ট বাহিনীকে রক্ষা করে বরং এট্রিশনাল যুদ্ধকে (প্রতিপক্ষের রিসোর্স ক্ষয় করে তাদের দুর্বল করা) এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এই আশায় যে পশ্চিমারা, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত সমর্থন সরবরাহ করবে। এখন ইউক্রেইন কোন বিকল্পটি বেছে নেয় সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্যসুত্র: The New York Times
আপনার মতামত জানানঃ