সুমিত রায়
সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের সরকারের পতন ঘটেছে বা সরকার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছে, নভেম্বরের আগে নতুন সরকারের জন্য সাধারণ নির্বাচন হবেনা। অভিবাসন ও এসাইলাম সিকার বা এসাইলাম সিকারদের নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ৮ জুলাই ডাচ সরকারের পতন ঘটে, ২০২১ সালে সরকার গঠনের মাত্র ১৮ মাস পর। এর তিন দিন পর ১০ জুলাই নেদারল্যান্ডসের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ঘোষণা দেন যে, তিনি পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং টানা ১৩ বছর দায়িত্ব পালনের পর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন। তো কী ঘটেছিল, কেন সরকার ভেঙে পড়ল এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। কিন্তু সেই সাথে আরো একটু অতীতে গিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোচনা করা দরকার নেদারল্যান্ডসের বর্তমান রাজনৈতিক হাওয়াকে বোঝার জন্য। সেটা হল বর্তমানে দেশটির উচ্চ কক্ষ মানে অপার হাউজে সবচেয়ে বেশি আসন যে পার্টির সেই পার্টি এই ভেঙে যাওয়া কোয়ালিশন সরকারের ছিলোনা। অন্য একটি নতুন উত্থিত পার্টির ছিল। এদের উত্থানের সাথে মার্ক রুটার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দলগুলোর জনপ্রিয়তাও অনেকটাই পড়ে গেছে।
১৬ই মার্চ নেদারল্যান্ডসে রিজিওনাল কাউন্সিলের সদস্যদের নির্বাচন শুরু হয়। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের কাউন্সিলরদের নির্বাচন নিয়ে পড়তে গেলাম কেন? কারণ, এই কাউন্সিলররা নেদারল্যান্ডস সংসদের উচ্চ কক্ষ সিনেটের সদস্যদের নির্বাচিত করে, আর দেশটিতে সিনেটের ক্ষমতা ভালো রকমই। অনেক ডাচ ভোটারের কাছে এই নির্বাচনের ফলাফল বেশ বিস্ময়কর ছিল। এই নির্বাচন কার্যত মার্ক রুটা (Mark Rutte) সরকার নিয়ে একটি গণভোটে পরিণত হয়েছিল। ১৫ই মার্চ সন্ধ্যায় প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ৬০% ভোটার বলেছেন যে তারা এই নির্বাচনটিকে দেশের সরকার সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশের একটি উপায় হিসেবে দেখেছে। ইলেকশনটিতে সরকার প্রধান মার্ক রুটার পার্টি ভাল ফল করেনি, সেই সাথে যে চারটি দোল নিয়ে জোট সরকার বা কোয়ালিশন পার্টি গঠিত সেগুলোর একটিও ভাল ফল করেনি। এই নির্বাচনের বড় বিজয়ী ছিল নতুন সরকার বিরোধী কৃষকপন্থী দল ফার্মার সিটিজেন মুভমেন্ট বা বিবিবি। তাই সব মিলে নেদারল্যান্ডসের রাজনীতি বুঝতে ও সামনের নির্বাচনে কী হতে পারে তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে এই বিবিবি পার্টির উত্থান সম্পর্কেও জানা দরকার। আর সেটার আলোচনায় আগে আসবে। তাই একটু দীর্ঘ আলোচনার জন্য প্রস্তুত হন।
ডাচ নির্বাচনী ব্যবস্থা
প্রথমে খুব দ্রুত ডাচ নির্বাচনী ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করে শুরু করা যাক। নেদারল্যান্ডসে সংসদের দুটি কক্ষ নিয়ে নির্বাচন হয়: (১) হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস, যা কোন ইলেকটোরাল থ্রেসহোল্ড ছাড়াই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা প্রপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন সিস্টেমের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত ১৫০ জন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এবং (২) সিনেট, যার ৭৫ জন সদস্য রয়েছে যারা দেশের ১২টি প্রদেশের আঞ্চলিক কাউন্সিল দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। আঞ্চলিক নির্বাচনগুলি তাই কার্যত জাতীয় সিনেট নির্বাচন। এর অর্থ হ’ল এখানকার আঞ্চলিক নির্বাচন অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির আঞ্চলিক নির্বাচনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নেদারল্যান্ডসে সিনেট অন্যান্য ইউরোপীয় উচ্চকক্ষের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে বেশি ক্ষমতা ধারণ করে। নেদারল্যান্ডসের যেকোন আইন পাশের জন্য সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদন প্রয়োজন। এর অর্থ হ’ল সিনেট নির্বাচন যে কোনও ডাচ সরকারের জন্য অনেক বেশি তারপর্য বহন করে, বিশেষত যখন ডাচ ফার্মগুলোতে নাইট্রেট দূষণ সীমাবদ্ধ করার জন্য রুটার পরিকল্পনার মতো বিতর্কিত আইন পাস করার ব্যাপার সামনে আসে।
নাইট্রোজেন নির্গমনের সমস্যা ও তা কমানোর জন্য আনা প্রস্তাব
নেদারল্যান্ডসের রাজার নেতৃত্বে কাউন্সিল অফ দ্য স্টেট সরকারের একটি উপদেষ্টা সংস্থা রায় দিয়েছিল যে নেদারল্যান্ডসের বিদ্যমান পরিবেশগত আইনগুলি তার নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া নির্গমন লক্ষ্যপূরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এরপর গত বছর রুটা ঘোষণা করেন যে তিনি ২০৩০ সালের মধ্যে নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন ৫০% হ্রাস করতে চান। এর ফলে নির্গমন সীমাবদ্ধ করার অন্য কোনও উপায় না পাওয়া পর্যন্ত সরকার আর রাস্তা বা বিল্ডিং তৈরি করতে পারবে না, কারণ এই উভয় ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেই নাইট্রোজেন নির্গত করে। অন্যথায় তারা নিজেদের আইনই ভঙ্গ করবে। এদিকে নেদারল্যান্ডসের সমস্ত নাইট্রোজেন নির্গমনের ৪০% আসে দেশটির কৃষি থেকে, তাই সরকার একটি অত্যন্ত সাহসী প্রস্তাব দিয়ে ফেলে – পশুপালন বা এনিমেল হাসব্যান্ড্রিকে কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করতে হবে, কেননা গবাদি পশুর খামারগুলোই দেশটির মোট কৃষিজ নাইট্রোজেন নির্গমনের ৬% এর জন্য দায়ী। আর এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে দেশটির ১০ লাখেরও বেশি গরু, ৪০ লাখেরও বেশি শূকরকে নির্মূল করতে হবে যার ফলে কিনা দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ খামার বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে যা হবার ছিল তাই হল। কৃষকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালো, ট্র্যাক্টর দিয়ে পুরো দেশকে অবরুদ্ধ করল, সরকারী ভবনগুলিতে জৈব সার নিক্ষেপ করল, এমনকি পুলিশকেও আক্রমণ করতে শুরু করল।
এরপর বিক্ষোভ শান্ত হয় বটে, কিন্তু এটি কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ফার্মার সিটিজেন মুভমেন্ট বা বিবিবি পার্টিকে আরো জনপ্রিয়তা দান করে, এর কার্যক্রমকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মতাদর্শগতভাবে, এরা আসলে একটি আদর্শ ডানপন্থী ইউরোপীয় পপুলিস্ট পার্টি, যারা কৃষকদের ওপর বিশেষভাবে ফোকাস করে। যেমন, তারা বায়ু এবং সৌর শক্তি সহ সবুজ রাজনীতি সম্পর্কে স্কেপ্টিক, খুব একটা পছন্দ করেন। আর তারা যেমন তথাকথিত শহুরে অভিজাতদের পছন্দ করেনা, তেমনি অভিবাসন বা ইমিগ্রেশনও পছন্দ করে না। এছাড়াও, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করতে না চাইলেও ইউরোপের অনেক ডানপন্থী পপুলিস্ট দলগুলির মতো কিছুটা ইউরোস্কেপটিক। তারা জোর দিয়ে বলে, ইইউকে তারা ফেডারেল সুপারস্টেট হিসেবে দেখতে চায় না (যা তাদের দেশকে নিয়ন্ত্রণ করবে)।
বিবিবি পার্টির উত্থান ও উত্থানের পেছনে রহস্য
এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ, গত দুই বছরে বিবিবি পার্টির অভূতপূর্ব উত্থান ঘটেছে। ২০২১ সালে এদের ভোট ছিল মাত্র ১%। সেখান থেকে এরা রুটার সরকারের একরকম প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়, আর এরপর ১৬ই মার্চের আঞ্চলিক নির্বাচনে এরা শীর্ষে উঠে এসেছে, তারা দেশের প্রতিটি প্রদেশে সর্বাধিক সংখ্যক ভোট লাভ করেছে। কিছু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে বিবিবি চূড়ান্তভাবে প্রভাবশালী ছিল, সেগুলোতে এরা ৩০% এরও বেশি ভোট পেয়েছিল, এবং অন্য কোনও দল ১০% এর বেশি ভোট পায়নি। নেদারল্যান্ডসের সিনেটে রয়েছে মোট ৭৫টি আসন। ৩০ মে-তে দেশটিতে পরোক্ষ ভোটের প্রভিন্সিয়াল স্টেইট ইলেকশনের মাধ্যমে সদস্যরা সিনেটের আসন লাভ করে। কিন্তু কোন দল কত আসন পাবে, করা ক্ষমতা দখল করবে তা তো ঠিক হয়ে গেল ১৬ই মার্চের আঞ্চলিক নির্বাচনেই। বিবিবি পার্টি পেল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন, ১৬টি আসন। অন্যদিকে মার্ক রুটার ভিভিডি পেলো মাত্র ১০টি আসন। নেদারল্যান্ডসের সরকার কোয়ালিশন সরকার। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ বা নিম্ন কক্ষ ১৫০টি আসন নিয়ে গঠিত, যেখানে ভিভিডির আসন সংখ্যা ৩৪টি, আর দলটি ডি৬৬, সিডিএ, সিইউ পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে যার মোট আসন সংখ্যা হয় ৭৭টি। তো সিনেটে দেখা গেল কোয়ালিশনের এই চার পার্টি, মানে ভিভিডি, ডি৬৬, সিডিএ, সিইউ পার্টি আসন পেয়েছে যথাক্রমে ১০, ৬, ৫ ও ৩টি। এভাবে সিনেটের ৭৫টি আসনের মধ্যে বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের আসন সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ২৩টি, যেখানে বিবিবি এর আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৬টি।
তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিবিবি এর এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে রহস্য কী? বিবিবি সফলভাবে কেবল ডানপন্থী লোকদেরই নয়, অধিকতর মধ্যপন্থী ভোটারদেরও মন জয় করেছে। গ্রামাঞ্চলের এই তুলনামূলক মধ্যপন্থী ভোটাররা ছিল সম্প্রতি কোয়ালিশন সরকারের দলগুলি, বিশেষত ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক আপিল (সিডিএ) এবং ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়নের (সিইউ) এর ভোটব্যাংক। কিন্তু গবাদি পশুর খামার নিয়ে সাম্প্রতিক ঘোষণাগুলোর পর এরা সিডিএ ও সিইউ পার্টির প্রতিও হতাশ হয়ে যায়। বিবিবি ডাচ পপুলিস্ট ডানপন্থীদের বিভাজন দ্বারাও উপকৃত হয়, কেননা এই ডানপন্থী পপুলিস্ট পার্টিগুলো বিবিবির বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে তাদের বেশিরভাগ সময় নিজেদের মধ্যে লড়াই করতেই ব্যয় করেছিল। আর তার প্রতিফলন তারা ব্যালট বাক্সেও দেখে। উদাহরণস্বরূপ, ফোরাম ফর ডেমোক্রেসি (FvD) মাত্র ৩% ভোট পেয়েছে, সিনেটে আসন পায় দুটো, যেখানে ২০১৯ সালে তারা সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৬% ভোট পেয়ে ১২টি আসন জিতেছিল।
সরকারের সংকটের সূচনা
প্রথমত, এটি সরকারের জন্য বেশ খারাপ খবর ছিল, কেননা এক্ষেত্রে সিনেটে সরকারের উভয় পাশেই শক্তিশালী বিরোধী ব্লক থাকছে। এর ডানদিকে থাকছে ডানপন্থী বিবিবি এবং বাম দিকে থাকছে বামপন্থী গ্রিন লেবার (গ্রিন পার্টি ও লেবার পার্টির জোট)। এই অবস্থায় সরকারকে যেকোনও উল্লেখযোগ্য আইন পাস করতে হলেই স্ট্রাগল করতে হয়। যেমন নাইট্রোজেন এজেন্ডার কথাই ধরা যাক। গ্রিন ও লেবার পার্টি শুরুতে এর পক্ষে থাকলেও, সরকারের পার্টি পপুলারিটি হওয়ায় পরবর্তীতে এর পক্ষে আগের মতো আর সমর্থন নাও দিতে চাইতে পারে, কেননা ভোট হারাবার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া এই পার্টিগুলোও এই অবস্থায় নাইট্রোজেন এজেন্ডায় সমর্থন দেবার বিনিময়ে সরকারের দলগুলোর কাছ থেকে কোন কনসেশন আদায় করে নিতে চাইতে পারে। তাই সব মিলেই এরকম অবস্থা সরকারের জন্য সমস্যাশঙ্কুল হয়ে ওঠে। আর এটাই রুটার সরকার ও রুটাকে দুর্বল করে দেয়। এরকম অবস্থায় জোট সরকারের মধ্যকার সম্পর্কও ঠিক টেকসই থাকেনা। দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে, অচলাবস্থা বাড়তে থাকে। আর সেটাই নিয়ে যায় দ্বন্দ্ব ও চূড়ান্তভাবে সরকারের ভাঙ্গনে। তবে সরকার পতনের আসল কারণ নিয়ে আলোচনা এখনো বাকি।
ভেঙ্গে পড়া জোট সরকারের খেলোয়াড়েরা
সবার আগে, যে কোয়ালিশন গভর্নমেন্টটি ভেঙ্গে পড়ল তার মূল খেলোয়াড়দের সম্পর্কে একটু বর্ণনা দেয়া যাক। এই মধ্য-ডানপন্থী জোটটির চারটি দলের মধ্যে বৃহত্তম হ’ল মার্ক রুটের নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি ফর ফ্রিডম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (ভিভিডি)। তারপরে আসছে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ডেমোক্র্যাট ৬৬ (ডি৬৬)। তৃতীয় বৃহত্তম হ’ল খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক আপিল (সিডিএ), এবং সরকারের চতুর্থ এবং ক্ষুদ্রতম সদস্য হ’ল খ্রিস্টান ইউনিয়ন (সিইউ)। হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ এদের আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৩৪, ২৪, ১৪ ও ৫টি করে। সব মিলিয়ে ১৫০ আসনের নিম্নকক্ষে এই জোটের আসন সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৭৭টি আসন রয়েছে, যা বেশ সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ২০২১ সালের মার্চের সাধারণ নির্বাচনের পরে এই জোট সরকারটি গঠিত হয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেই নির্বাচনের আগেও এই জোট সরকারই ক্ষমতায় ছিল। সেক্ষেত্রে এদের আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৩, ১৯, ১৯ ও ৫টি করে, মোট ৭৬টি আসন। তবে ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে এই জোটটি একটি চাইল্ডকেয়ার স্ক্যান্ডালের কারণে ভেঙে পড়েছিল, যেখানে হাজার হাজার বাবা-মাকে বেনিফিট ফ্রডের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে পরবর্তী নির্বাচন এবং প্রায় ৭৭ দিনের কঠিন সমঝোতার পরে এই একই চারটি দল পুনরায় একটি নতুন জোট গঠনে সম্মত হয়। এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই জোটটি ২০২১ সালে নতুন করে গঠিত হবার সময় থেকেই কিছুটা নড়বড়ে ছিল।
এসাইলাম সিস্টেম নিয়ে সমস্যা
তো এবারে এসাইলাম সিকার বা আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে দ্বন্দ্বে ব্যাপারটায় যাওয়া যাক। গত বছর নেদারল্যান্ডসে ৪৬ হাজার এসাইলাম এপ্লিকেশন এসেছে, যা আগেরবারের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেশি ছিল। আর এ বছর এর সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবং অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মতো, ডাচ সরকারও এই সংখ্যাটি হ্রাস করার জন্য রাজনৈতিক চাপ অনুভব করছে। শুধু সংখ্যাটাই সমস্যার নয়; ডাচ এসাইলাম সিস্টেমও ব্যবস্থা ভাল অবস্থায় নেই, বিশেষভাবে, এসাইলাম সিকারদের জন্য বেসিক শেল্টারের ব্যবস্থা করাটাও সমস্যার হয়ে যাচ্ছে। গত বছর দেশটির টের আপেল (Ter Apel) গ্রামে এসাইলাম সিকারদের রিসেপশন সেন্টারে তিন মাস বয়সী একটি শিশুর মৃত্যু হয়। আর মাঝে মাঝে শত শত এসাইলাম সিকারদেরকে ঘনবসতিপূর্ণ সেন্টারের বাইরে ঘুমোতে হয়েছে।
কয়েক মাস ধরে, সরকার এই এসাইলাম সিকারদের সংখ্যা কমাতে এবং এসাইলাম সিস্টেমের উপর চাপ কমাতে একটি নতুন প্যাকেজ নিয়ে আসার জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছিল। রুটা এবং তার ভিভিডি পার্টি একটি টু-স্ট্যাটাস সিস্টেম চালু করার জন্য চাপ দিচ্ছিল, যা কার্যকরভাবে এসাইলাম সিকারদের দুটি স্তরে বিভক্ত করবে: এ স্ট্যাটাস ও বি স্ট্যাটাস। এ স্ট্যাটাসের শরণার্থীরা হবে তারা যারা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের দেশে নিপীড়নের ঝুঁকিতে থাকবে, হয়তো তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা যৌনতা সংক্রান্ত পরিচয়ের মতো বিষয়গুলির জন্য। অন্যদিকে বি স্ট্যাটাসযুক্ত শরণার্থীরা হবে যুদ্ধ বা সংঘাতের জন্য নিজ দেশ থেকে পালিয়ে আসা লোকেরা। এখন এই টু-স্ট্যাটাস সিস্টেম অনুসারে, এ স্ট্যাটাসের এসাইলাম সিকারদেরকে নেদারল্যান্ডসে স্থায়ী ভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হবে এবং অধিকতর অধিকার ভোগ করতে দেয়া হবে, অন্যদিকে বি স্ট্যাটাসের এসাইলাম সিকারদেরকে কেবল অস্থায়ী অনুমতি দেয়া হবে, এবং পারিবারিক পুনর্মিলন বা ফ্যামিলি রিইউনিয়নের মতো বিষয়গুলোতে তারা কম অধিকার পাবে। বিশেষত, ভিভিডি পার্টি নেদারল্যান্ডসে বি স্ট্যাটাস যুদ্ধভিত্তিক শরণার্থীদের সাথে যোগ দিতে পারে এমন ফ্যামিলি মেম্বারদের সংখ্যা (শিশু সহ) প্রতি মাসে ২০০-তে সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছিল, পাশাপাশি সেই আত্মীয়দের দেশে প্রবেশের আগে দুই বছরের বাধ্যতামূলক অপেক্ষার সময়সীমা চালু করতে চেয়েছিল।
প্রস্তাব নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সরকার পতন
সিডিএ এই প্রস্তাবটি সমর্থন করেছিল। কিন্তু জোটের অন্য দুটি জোট দল, ডি৬৬ এবং বিশেষত সিইউ এর বিরোধিতা করে। ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়নের নেতা তার দলের পরিবারপন্থী অবস্থানের উপর জোর দিয়ে বলেন, এমন কিছু জিনিস রয়েছে যা আপনি আমাদের কাছ থেকে চাইতে পারেন এবং এমন কিছু জিনিস রয়েছে যা আপনি আমাদের কাছ থেকে চাইতে পারেন না। এখন, মার্ক রুটা চাইছিলেন জোটটি দ্রুত কোনও ধরণের চুক্তিতে আসুক, আর তাই তিনি একটি চুক্তিটি করার জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। এরপর দ্বন্দ্ব শুরু। দলগুলিকে একত্রিত করার চেষ্টা করার জন্য তখন একাধিক সংকট নিয়ে আলোচনা হয়, কিন্তু দলগুলোর মতাদর্শগত পার্থক্যগুলো খুব বেশিই ছিল। অবশেষে রুটা জোট সরকারের ভাঙ্গনের ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, সিদ্ধান্তটি নেয়া আমাদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল, তবে আমাদের দলগুলোর মধ্যকার পার্থক্যগুলি মিটমাটযোগ্য নয়।
তাহলে এখন কি হবে? মার্ক রুটা রাজার কাছে মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিভিন্ন আইন, ছুটি ও অন্যান্য কারণে নভেম্বরের মাঝামাঝির আগে পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। এই কারণে, কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে, রুটা সরকারের পতন ঘটাবার জন্যই ফ্যামিলি রিইউনিয়নের মতো প্রস্তাবগুলি সামনে এনেছেন, যেগুলো কখনোই মানবার মতো নয়। এদের যুক্তি হচ্ছে, এর ফলে সামনের নির্বাচনটি অভিবাসন-কেন্দ্রিক হয়ে যাবে, এবং ভোটারদের মনে তার ভিভিডি পার্টির জন্য নিজেদেরকে অভিবাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটি পার্টি হিসাবে স্থাপন করা সম্ভব হবে, আর এর মধ্যে দিয়ে দলটি কট্টরপন্থী ইসলাম বিরোধী ও অভিবাসন বিরোধী দল পার্টি ফর ফ্রিডম (পিভিভি) এর মতো কট্টরপন্থীদের কাছ থেকে সমর্থন সংগ্রহ করতে পারবে ও আরো বেশি করে দক্ষিণন্থীদের ভোট দখল করতে পারবে। যাইহোক, এটা ভাবা বোকামি হবে যে অভিবাসন আগামী মাসগুলিতে একমাত্র সমস্যা হবে। কৃষি খাত, জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসন, জনসেবা এবং আরও অনেক কিছুই নির্বাচনের আগে উত্তপ্ত বিতর্ক তৈরি করবে।
নেদারল্যান্ডসের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
সামনের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ফার্মার সিটিজেন মুভমেন্টের (বিবিবি) দিকেও প্রচুর মনোযোগ রয়েছে, এটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন দল যা গবাদি পশুর সংখ্যা হ্রাস এবং কৃষি দূষণ কমানোর জন্য নেয়া সরকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদকে সমর্থন করে খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, তারা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশকে হতবাক করে দিয়েছিল এবং এখন তারা এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই দলটি কি সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক নির্বাচনের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে? বিবিবি’র দলীয় নেতা বলেছেন, তারা আত্মবিশ্বাসী যে তারা পারবেন। তারা বলছেন, “আমাদের সমস্ত ব্যানার এখনও গুদামে রয়েছে, আগামীকাল সেগুলি আবার মাঠে রাখা যেতে পারে। আমরা শুধু এক প্রচারাভিযান থেকে অন্য প্রচারাভিযানে যাচ্ছি।” অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও স্পষ্টতই রুটাকে এই আগাম নির্বাচনের সুবিধা নিতে বাধা দিতে আগ্রহী ছিল, বিরোধীরা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রুটাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে অনাস্থা ভোটও উপস্থাপন করেছিল।
তবে সোমবার একটি বড় সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে রুটা বলেন, ‘সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জল্পনা-কল্পনা চলছে, কী আমাকে সরকারকে ভেঙ্গে দিতে অনুপ্রাণিত করল। এর একমাত্র উত্তর হলো নেদারল্যান্ডস। আমার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে এর অধীনস্থ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আসন্ন নির্বাচনে আমি ভিভিডির নেতা হিসাবে ভোট দাঁড়াবো না।” সুতরাং মনে হচ্ছে, টিকে থাকার ক্ষমতার জন্য টেফলন মার্ক নামে পরিচিত মার্ক রুটা আগামী নির্বাচনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার ১৩ বছরের মেয়াদ শেষ করবেন। এরপর কী হয় তা দেখার বিষয়। ভিভিডিকে স্পষ্টতই নির্বাচনে নেওয়ার জন্য একটি নতুন নেতা খুঁজে বের করতে হবে, যেমন জোটের সদস্য সিডিএ নেতা, যিনি সরকারের পতনের পরে পদত্যাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। ডাচ বামপন্থীরা বেশ কয়েক বছর ধরে কোন সাফল্য পায়নি, তাদেরও আসছে নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রিন বাম দল এবং লেবার পার্টি এখন যৌথভাবে ক্যান্ডিডেটদের তালিকা তৈরির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে, যা তাদেরকে বেশ শক্তিশালী প্রতিযোগী করে তুলতে পারে। তবে পরবর্তী নির্বাচনের আগে অনেক সময় রয়েছে এবং বেশ কয়েকটি দলকে এখনও নতুন নেতা নির্বাচন করতে হবে। তাই বলা যায়, নেদারল্যান্ডসের পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য এখনও অনেক সময় রয়েছে, এবং এই বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের ভোটার স্ট্যাটিসকটিক্স যে আগামী নির্বাচনের ফলাফলেও প্রতিফলিত হবে এমন কোন কথাও নেই।
আপনার মতামত জানানঃ