অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে প্রবাহমান জলধারা। তবে এই নদীপথ ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে এক অদ্ভুত দৃশ্যের। গতি কমতে কমতে হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে নদী।
পড়ে আছে শূন্য নদীখাত। বিন্দুমাত্র জল নেই সেখানে। নুড়ি-পাথর বিছানো সেই নদীখাতে অনায়াসে হাঁটতে পারবে যে-কোনো মানুষ। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল নদীর জল?
রাশিয়ার ভোল্গা এবং রাইনকে বাদ দিলে, ইউরোপের অন্যতম প্রধান নদী দানিউব। ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীও বটে। বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৃষিকাজ কিংবা পরিবহন— জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ প্রাচীনকাল থেকেই নির্ভর করেছে এই নদীর ওপর।
তবে ইউরোপের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীই অকস্মিক অদৃশ্য হয়ে যায় জার্মানির একটি বিশেষ অংশে।
এমনটা শুনলে একটু অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, যেকোনো ম্যাপ খুললেই দেখা যাবে জার্মানিতেই জন্ম দানিউব বা ডোনাউ নদীর। তারপর প্রায় দশটি দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা গিয়ে মিশেছে কৃষ্ণসাগরে।
জার্মানিতেই যদি অদৃশ্য হয়ে যায় দানিউব, হারিয়ে ফেলে জলধারা, তবে কৃষ্ণসাগরে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে কীভাবে দানিউব?
আসলে জার্মানির দুটি ছোটো নদী ব্রেগ ও ব্রাইগাচ মিশ্রিত হয়েই জন্ম দিয়েছে দানিউবের। জার্মানির ডোনায়েশিঞ্জেন অঞ্চলে অবস্থিত এই সঙ্গমস্থল থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ইমেন্ডেনজেন শহরের কাছে শুকিয়ে যায় এই জলধারা।
অন্যদিকে এই অঞ্চল থেকে সাড়ে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আচটোফে ফের প্রাণ ফিরে পায় দানিউব। ভূগর্ভস্থ জল ঝর্ণার আকারে বেরিয়ে এসে ভরিয়ে দেয় নদীখাত।
অবশ্য সারা বছর চোখে পড়ে না এই দৃশ্য। বছরে গড়ে ১৫৫ দিন শুকনো থাকে মধ্যবর্তী নদীখাত। বছরের বাকি সময় অতিক্ষীণ জলধারা প্রবাহিত হয় মধ্যবর্তী এই উপত্যকায়। মূলত গ্রীষ্মকালেই সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যায় দানিউবের এই বিশেষ অংশটি।
একটা সময় পর্যন্ত ধরে নেওয়া হত ডোনায়েশিঞ্জেন থেকে ইমেন্ডেনজেন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে একটি ভিন্ন নদী। এই ধারাটিকে গিলে খেয়েছে মাটিতে লুকিয়ে থাকা অজানা কোনো সিঙ্কহোল। অন্যদিকে দানিউবের জন্ম আচটোফের ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা বা প্রস্রবণের মাধ্যমে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপীয় ভূতাত্ত্বিকরা সন্দেহ করতে শুরু করেন এই দুই প্রবাহ আসলে অভিন্ন। প্রকাশ্যে আসে নানান তত্ত্ব। দাবি করা হয়, ডোনায়েশিঞ্জেনে মাটির তলা দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে দানিউব। অর্থাৎ, দানিউব অন্তঃসলিলা। অনেকটা ভারতের ফল্গু নদীর মতোই।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই তত্ত্ব প্রমাণিত হয় ১৮৭৭ সালে। নেপথ্যে জার্মান ভূতাত্ত্বিক অ্যাডলফ নপ। তারিখটা ছিল ৯ অক্টোবর। ইমেন্ডেনজেন শহরের কাছে নদীর জলে প্রায় ১০ কিলোগ্রাম সোডিয়াম ফ্লুরোসিন, ২০ টন লবণ এবং ১ টন জৈব তেল মিশিয়ে দেন নপ।
এর ঠিক ৬০ ঘণ্টা পরে এক অদ্ভুত দৃশ্যের দেখা মেলে আচটোফে। দেখা যায় বদলে গেছে ভূগর্ভস্থ জলের ঝর্ণার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ। এই পরীক্ষাই প্রমাণ করে দানিউব অন্তঃসলিলা।
আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী ইমেন্ডেনজেন শহরের পর দীর্ঘ ১২ কিমি দীর্ঘ দানিউবের উপত্যকা তৈরি মূলত নুড়ি এবং বেলেপাথরে। তার বহু নিচে রয়েছে গ্রানাইটের স্তর। ফলে সরাসরি নদীর জল শুষে নিতে পারে না মাটি। সেখানে সিঙ্কহোল-ও নেই কোনো।
বরং বেলেপাথরের ফাটল দিয়ে মূল নদী প্রবাহিত হতে থাকে এই অঞ্চলে। আচটোফের কাছে বেলে পাথরের স্তর পাতলা হয়ে যাওয়ায় ঝর্ণার আকারে বেরিয়ে আসে ভূগর্ভস্থ এই স্রোত। গ্রীষ্মে ভূপৃষ্ঠের উপরের নদী অর্থাৎ বাহ্যিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলেও সক্রিয় থাকে দানিউবের ভূগর্ভস্থ প্রবাহ।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ৮ হাজার লিটার জল প্রবাহিত হয় অন্তঃসলিলা দানিউবে। অন্তঃসলিলা দানিউবের এই প্রবাহমাত্রার কাছে হার মানে ইউরোপের অধিকাংশ নদীই।
এসডব্লিউএসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ