সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচির দু’দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। এর আগে ঢাকা-১৭ আসনের উপ নির্বাচনেও এক স্বতন্ত্র প্রার্থী হামলার শিকার হন, যা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েছে। রাজনীতিতে ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’ বজায় রাখার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির তরফ থেকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করার পরেও রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিএনপি নেতাদের দাবি – সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সহিংস হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দাবি করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির নামে নিজেরাই সহিংস হয়ে উঠছে।
এক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে কোন আপোষ, মীমাংসার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। বরং সামনে সংঘাত আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও কি বাংলাদেশের রাজনীতি আবার সহিংস রূপ নিচ্ছে?
সহিংসতার যত ঘটনা
মঙ্গলবার ১৮ই জুলাই বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলায় একজন নিহত, প্রায় দুই হাজার আহত এবং এক হাজারের বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে বিএনপি তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছে। ওই বিবৃতি অনুযায়ী দেশের মোট আট জেলায় তাদের নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন।
এরমধ্যে লক্ষ্মীপুরে পদযাত্রা চলাকালে কৃষক দলের নেতা সজীব হোসেনকে পদযাত্রার পেছন থেকে টেনে নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে বলে তারা অভিযোগ করেন।
এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালালে তিন শতাধিক নেতাকর্মী আহত হবার অভিযোগ করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
খাগড়াছড়িতে পদযাত্রা চলাকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অন্তত দুইশ’ নেতাকর্মী এবং ফেনীতে প্রায় দেড়শ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হন, যাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। খাগড়াছড়িতে বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালানো হয় এবং বিএনপির ৫০ জনের বেশি নেতা কর্মীকে গ্রেফতারের কথা জানায় দলটি।
বগুড়ায় পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালীন পুলিশ গুলি চালালে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এ সময় পুলিশের টিয়ারগ্যাস শেলের আঘাতে স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা আহত হন।
কিশোরগঞ্জেও পুলিশের হামলায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত হন। এছাড়া জয়পুরহাটে অর্থ শতাধিক নেতাকর্মী, পিরোজপুর জেলায় পুলিশের অতর্কিত হামলা ও গুলিবর্ষণে ২০ থেকে ২৫ জন নেতা কর্মী গুরুতর আহত হন।
নেত্রকোনা জেলায় বিএনপির পদযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য আসার পথে দুইজন এবং কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে একজনের উপর হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা গুরুতর আহত করে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
এছাড়া ঢাকায় সরকারি বাঙলা কলেজের সামনে ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিএনপি’র কিছু নেতাকর্মী কলেজ গেটে ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ ওঠে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
কোথাও কোথাও বিএনপির পদযাত্রা শেষে আওয়ামী লীগের ‘শান্তি’শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেল ও গাড়ি ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়। এসব সংঘাতের ঘটনায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের দাবিতে বিএনপি এবং আরও ৩৬টি দল গত ১২ই জুলাই ঢাকায় সমাবেশ করে পদযাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। তারই অংশ হিসেবে ঢাকাসহ সারা দেশে পদযাত্রার কর্মসূচি পালন করছে দলটি।
পরিস্থিতি কেমন হবে?
গত কয়েক মাস ধরে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করলেও তা বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই চলেছে। কোথাও বড় কোন হামলার খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিএনপির এবারের পদযাত্রা কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উদ্রেক করেছে যে সামনের দিনের কর্মসূচিগুলোয় সংঘাত আরও প্রকট রূপ নেবে কিনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের কর্মসূচি দমনে কঠোর হতে পারে। বিএনপিও সামনে পাল্টা শক্ত অবস্থান নিতে পারে। সরকার পরিকল্পিতভাবে সহিংস হয়ে উঠছে বলে দাবি করছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে সরকারের মধ্যে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার উদগ্র কামনা বেশ জোরদার হয়েছে। যে কারণে মঙ্গলবার বিএনপির সমাবেশে এবং এর আগে ঢাকা-১৭ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলমের ওপর হামলা হয়েছে।”
“আওয়ামী লীগকে আতঙ্ক এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে আতঙ্কের খোলস ঝেড়ে ফেলার জন্য তারা এখন আক্রমণ শুরু করেছে যেটা আমাদের পক্ষ থেকে কাম্য ছিল না।”
এক্ষেত্রে পুলিশ সরকারের হয়ে কাজ করছে, সামনে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হবে বলে আশঙ্কা করছেন হোসেন জানান, “আমরা উদ্বেগ ও আশঙ্কার মধ্যে আছি কারণ সরকার নানা ধরনের নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ কব্জা করে নিয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আমাদের যে কর্মীরা আহত হয়েছেন তাদেরকেই আবার আসামি করে মামলা করা হয়েছে।”
“শেষ দিকে এসে তারা আমাদের নেতাকর্মীদের কারাগারে নিক্ষেপ করছে। পুলিশ শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নিরাপত্তা দেয় অন্য কাউকে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ নেই। নাহলে আশরাফুল আলমকে এভাবে মার খেতে হতো না।”
তবে এই সহিংসতার পেছনে বিএনপিকেই দায়ী করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, “বিএনপি সুযোগ পেলেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তার উদাহরণ এই পদযাত্রা কর্মসূচি।”
“পদযাত্রার নামে তারা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে, হাসপাতাল-ব্যাংকে ভাঙচুর করেছে, মানুষের যানবাহন নষ্ট করেছে। তারা ক্ষমতায় থাকার সময় আবার বিরোধী দলে থাকার সময় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এখন তারা সেই দোষের দায়ভার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের উপর।”
এই সহিংসতা দমনে সরকার কঠোর ভূমিকায় যাবে বলে হুঁশিয়ারি করেন তিনি।
এসডব্লিউএসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ