ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ বাড়তে থাকায় চলতি বছরের মার্চ শেষে ১১ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে ৩৩,৫৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, ঘাটতিতে থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক বছরের পর বছর বড় ধরনের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির দুর্বলতা নির্দেশ করে। মূলত বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোয় মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা ছাড় ও নিবিড় তদারকির পরও তাদের মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। অন্যদিকে কিস্তি পরিশোধে ছাড় আর ঋণ নবায়নের শর্ত
শিথিলের সুযোগ নিয়ে অনেকে বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়েও খেলাপিমুক্ত থাকছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণ অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই এখন খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বছরের পর বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এ ছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিতে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় মার্চে ঘাটতি আরো ২,873 কোটি টাকা বেড়েছে। ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩০,৭০২ কোটি টাকার মতো।
প্রতিবেদন বলছে, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৭টি ব্যাংকই বর্তমানে মূলধন ঘাটতিতে আছে। ব্যাংকগুলো হলো- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৮,১১৭ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ১৪,০৯৪ কোটি টাকা ঘাটতিতে আছে কৃষি ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ব অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ডিসেম্বরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- বেঙ্গল কমার্সিয়াল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি; সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি কমাতে সরকারকে অর্থায়ন করতে হবে। তা না হলে তাদের সংকট কমবে না। তবে, নতুন করে অর্থায়ন করা হলে সেগুলো যেন আবার খেলাপী হয়ে না যায়, সরকারকে সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে।”
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ প্রতিমাসেই বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রভিশনও বাড়ছে, ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট এর ১০% অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
ব্যাংকখাতে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও ডিসেম্বরের ১১.৮৩% থেকে কমে মার্চে হয়েছে ১১.২৩%।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, তিন মাসে ব্যাংক খাতের সারপ্লাস ক্যাপিটাল ৭,৪২৫ কোটি টাকা কমে গেছে। ক্যাপিটাল শর্টফলে থাকা ব্যাংকগুলো বাদে বাকি ৫০টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৩টি ব্যাংকের সারপ্লাস ক্যাপিটাল বেড়েছে গত তিন মাসে। বাকিগুলোর কমেছে। মার্চ শেষে ব্যাংকখাতের সারপ্লাস ক্যাপিটাল দাঁড়িয়েছে ১৪,৩৭৩ কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো অনেক খেলাপী ঋণ ২/৩ মাসের জন্য রিশিডিউল করে। এর কারণ হলো, ডিসেম্বর শেষে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়, সেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতেই রিশিডিউল করা হয়।”
“তবে জানুয়ারি বা ফ্রেব্রুয়ারির দিকে এসব রিশিডিউলের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ এবং রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট বাড়ে। এজন্য ক্যাপিটাল শর্টফলও বাড়ে। এছাড়া যেসব ব্যাংকের শর্টফল নেই, তারাও একই প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখায়। তাই, মার্চ প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের সারপ্লাস ক্যাপিটাল কমে যায়,” বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, লোন রিশিডিউল করার কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমেছিল প্রায় ১৩,৭৫০ কোটি টাকা। তবে রিশিডিউল করা লোনের মেয়াদ শেষ হয়ে সেগুলো ফের খেলাপি হয়ে যাওয়ায় মার্চ প্রান্তিকে মোট খেলাপি ঋণ ডিসেম্বরের তুলনায় ১১,০০০ কোটি টাকা বেড়ে হয় ১,৩১,৬২১ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ব্যাংকের প্রফিট কমে গেছে। কারণ, প্রফিটের একটা অংশ খেলাপি ঋণের জন্য প্রভিশন খাতে চলে যায়।”
এসডব্লিউএসএস১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ