বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী দেখা দেয়ার পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে বাংলাদেশের অভিবাসন খাতে। বিশ্বে অভিবাসী কর্মীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে প্রথম সারিতে বাংলাদেশিরা। অভিবাসনের গন্তব্য দেশগুলোয় অবস্থানরত প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর হারও বেশি।
২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৬টি দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭০ হাজার জন মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৩৮০ জন অভিবাসী।সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে ২ হাজার ৩৩০ জনের বেশি বাংলাদেশি কর্মী করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
এর মধ্যে সৌদি আরবেই মৃত্যু হয়েছে ৯৮৯ অভিবাসীর। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর হার বেশি। গত জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩২৮ জনের। তাদের মাঝে ১২২ জনই বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া কুয়েতে কভিড-১৯-এর কারণে মৃতের সংখ্যা ৩৮২। তাদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ৬০।
সিঙ্গাপুরেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে প্রথম সারিতে বাংলাদেশি অভিবাসী।গত ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে করোনায় আক্রান্ত অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার, যা দেশটিতে বসবাসরত মোট অভিবাসী শ্রমিকের ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশি কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৩ হাজার। সে হিসেবে সিঙ্গাপুরে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত অভিবাসী শ্রমিকের ৪০ শতাংশই বাংলাদেশি। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, যেকোনো মহামারী পরিস্থিতিতে অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন। ১৯৩০-এর বিশ্বমন্দা, ১৯৭৩-এর জ্বালানি তেল সংকট, ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকট বা ২০০৯-১০ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। ২০২০ সালের কভিড-১৯ সংকটেও সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে ছিলেন অভিবাসী শ্রমিকরা।
প্রবাসী বাংলাদেশি, অভিবাসী ও কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন, গাদাগাদি করে ডরমিটরিতে কর্মীরা থাকতে বাধ্য হন। আবার যে সব জায়গায় কর্মীরা কাজ করেন সেখানে লোক সমাগম বেশি। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করা মৃত্যুর কারণ। তা ছাড়া করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনের একটি বড় অংশের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিল। করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনের অধিকাংশই ভর্তি হয়েছিলেন হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক, কিডনি রোগসহ নানান শারীরিক জটিলতায়। ভর্তির পরে অনেকের করোনা শনাক্ত হয়। আবার কারও কারও শনাক্ত হয় আগেই।
তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও বাংলাদেশে জনশক্তির মূল বাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জীবিকার বিষয়টি মূল সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। গত বছরে জুন বা জুলাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সৌদি আরবে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। যদিও সারা দেশে এখনো লকডাউন চলছে। তবে বাংলাদেশের নাগরিক বিশেষ করে অভিবাসীদের জন্য জীবিকার এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তেলের দরপতনের ফলে ওখানকার অর্থনীতিতে ধাক্কা লেগেছে। ফলে জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে গেছে। করোনাসংক্রমণের পর অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা লেগেছে। ফলে লোকজনের কাজে সুযোগ সীমিত হচ্ছে।
বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও এরই মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা আকাশপথে চলাচল হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন। আরও অনেকেই ফিরে আসতে চাচ্ছেন। আকাশপথে পুরোদমে চলাচল শুরু হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে পারেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য বলছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতারসহ ২৮টি বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৪ জন পুরুষ ও ৩৯ হাজার ২৭৪ জন নারী।
রামরুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী দুর্যোগকালে অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শ্রমগ্রহণকারী দেশের। সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতার অভিবাসী শ্রমিকদের বিনা মূল্যে কভিড-১৯ পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। তারা নিয়মিত ও অনিয়মিত অভিবাসীর মধ্যে এদিক থেকে কোনো তফাত করা হবে না বলেও নিশ্চিত করেছিল। তবে রামরুর সমীক্ষা অনুযায়ী, করোনাকালে শুধু যাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশের পরীক্ষা করানো হয়েছে। বাকিরা পরীক্ষা করানো ছাড়াই প্রত্যাবর্তন করেছেন। ধরা পড়ার ভয় থাকায় অনেক অনিয়মিত অভিবাসী কর্মী করোনার লক্ষণ দেখা দিলেও পরীক্ষা করাতে যাননি।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ