সাধারণভাবে আমরা জানি আলো কোনো বস্তু নয়। এটি চোখে দেখা যায়, কিন্তু ধরতে পারি না। আলো মানেই ফোটন—এক ধরনের শক্তির কণা, যার ভর নেই, যার অস্তিত্ব শুধু গতির মধ্যেই। কিন্তু বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত আমাদের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা যা করে দেখালেন, তা যেন বিজ্ঞানের ভাষায় রূপকথা—তারা প্রথমবারের মতো আলোকে পরিণত করলেন এক ধরনের কঠিন ও তরল উভয় রূপের অদ্ভুত পদার্থে, যার নাম সুপারসলিড। এটি শুধু গবেষণার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্তই নয়, বরং পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক নতুন দ্বার উন্মোচন।
সুপারসলিড এমন একধরনের কোয়ান্টাম পদার্থের অবস্থা, যেখানে কঠিনের মতো গঠনতন্ত্র ও তরলের মতো প্রবাহ—দুই বৈশিষ্ট্য একসাথে বিদ্যমান। এই পদার্থের কণাগুলো একদিকে যেমন সুশৃঙ্খলভাবে স্ফটিক কাঠামোয় আবদ্ধ, তেমনি আবার তারা একে অপরের ভেতর দিয়ে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে, একদম ঘর্ষণহীনভাবে। তরলের যে সান্দ্রতা বা viscosity থাকে—যেটি তরল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে—সেটি সুপারসলিডে একেবারে নেই। ফলে একবার চালনা শুরু হলে কোনো শক্তি ক্ষয় ছাড়াই পদার্থটি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে থাকে।
এই অবস্থাকে তুলনা করা যেতে পারে সুপারফ্লুইডের সঙ্গে—যেমন হিলিয়াম-৪ গ্যাসকে প্রায় শূন্য কেলভিন তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে সেটি এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে ঘর্ষণ ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে। এমনকি নিজেই পাত্র থেকে বেরিয়ে যেতে পারে! সেই একই রকম আচরণই এবার বিজ্ঞানীরা সুপারসলিডে দেখলেন—কিন্তু এবার কেবল পরমাণু বা গ্যাস ব্যবহার নয়, বরং আলো ও বস্তু মিলিয়ে।
এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক গ্যাস বা নির্দিষ্ট পরমাণু দিয়ে এই সুপারসলিড তৈরি করতেন। তবে এবার যা ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব—বিজ্ঞানীরা একত্রিত করেছেন আলো এবং পদার্থকে। এর জন্য তারা ব্যবহার করেছেন পোলারিটন সিস্টেম, যা একধরনের হাইব্রিড বা সংকর কণিকা। এই কণিকাটি গঠিত হয় ফোটন এবং এক্সাইটনের শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক মিথস্ক্রিয়ায়।
এক্সাইটন হলো, যখন কোনো ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে পরমাণুর কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে গিয়ে, পেছনে ফেলে দেয় একটি পজিটিভ গর্ত—তখন এই ইলেকট্রন-গর্ত যুগল মিলে তৈরি হয় এক্সাইটন। ফোটনের সঙ্গে এটি মিলে তৈরি হয় পোলারিটন। এই পোলারিটনের বিশেষত্ব হলো, এটি গ্যাসের মতোই শক্তির সবচেয়ে নিচের স্তরে স্থিরভাবে অবস্থান করতে পারে, যেটি সুপারসলিডের পূর্বশর্ত। ফলে বিজ্ঞানীরা এটিকে প্রায় শূন্য কেলভিনে ঠান্ডা করে এমন অবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে এই আলো-মিশ্রিত কণা কঠিন গঠনে রূপ নেয়, অথচ নিজেরাই চলাচল করতে পারে।
এই গবেষণার গুরুত্ব শুধু ‘আলোকে শক্ত বস্তুতে রূপান্তর’ করাতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আমাদের কোয়ান্টাম পদার্থের মৌলিক আচরণ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার দরজা খুলে দিয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রায় কণাগুলো এলোমেলোভাবে নড়াচড়া করে, কিন্তু তাপমাত্রা যত কমানো যায়, কণাগুলোর গতি তত সীমিত হয়ে যায় এবং তারা নিজ নিজ কোয়ান্টাম আচরণ প্রকাশ করতে থাকে। এই পর্যায়ে পদার্থকে খুব সূক্ষ্মভাবে বোঝা সম্ভব হয়, যেটি মূলত সুপারসলিডের গবেষণার আসল উদ্দেশ্য।
বিশেষ করে সুপারসলিডের ভেতরে কণার অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়া, গঠনের মধ্যে পরিবর্তন না এনেও তাদের অবস্থান পরিবর্তন, এবং ঘর্ষণ ছাড়াই চলার ক্ষমতা—এই বৈশিষ্ট্যগুলো ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ভিত্তি হতে পারে। যেমন—কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, যেখানে অনিশ্চয়তা ও সুপারপজিশন ব্যবহার করে প্রচলিত কম্পিউটারের তুলনায় বহুগুণ দ্রুত হিসাব করা সম্ভব। সুপারকন্ডাক্টর, যেখান দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। এমনকি হতে পারে ফ্রিকশনলেস লুব্রিকেন্ট—অর্থাৎ এমন তরল বা পদার্থ, যা যন্ত্রপাতির মধ্যে ঘর্ষণ ছাড়াই গতিশীলতা বজায় রাখবে।
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো এখনও অজানা। কিন্তু আলোকে যদি কঠিন রূপে পরিণত করা যায়, তবে আমাদের চেনা জগতের ধারণাগুলো যে বদলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ যেটিকে অসম্ভব মনে হচ্ছে, কাল সেটি নতুন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াবে। এই আবিষ্কার তেমনই এক বাস্তবতা—যেখানে পদার্থের গঠন, কণার গতি, শক্তির ব্যবহার—সবকিছু নতুনভাবে কল্পনা করা সম্ভব হবে।
আলো দিয়ে সুপারসলিড তৈরি করা নিছক একটি পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়—এটি আমাদের বাস্তব জগৎ, প্রযুক্তি, এমনকি মহাবিশ্ব নিয়ে ভাবনার পরিধি প্রসারিত করে। পদার্থবিজ্ঞানের গভীরে যাত্রা করে এমন সব কিছুকে বুঝে ফেলা, যেগুলো আগে ছিল কেবল তত্ত্বের মধ্যে—এই অভিযাত্রার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে ‘আলো দিয়ে কঠিন বস্তু’ তৈরির মাধ্যমে।
এবং একদিন হয়তো, এই আলোরই সুপারসলিড গঠনের মাধ্যমে তৈরি হবে এমন যন্ত্র, যা মানুষের ভবিষ্যতের চেহারাই বদলে দেবে। বিজ্ঞান একবার যখন সম্ভাবনার দিগন্তে পা রাখে, তখন সবকিছুই সম্ভব।
আপনার মতামত জানানঃ