২০১৭ সালের জুনে ভূমিধসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫০ জনেরও বেশি মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে সরকার একাধিকবার পাহাড় কাটা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টির অভাব ও পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতার ঘাটতির ফলে পাহাড় কাটা এখনো বন্ধ হচ্ছে না। এবার সরকার খোদ জড়িয়ে গেলো পাহাড় কাটা প্রতিযোগিতায়। একে তো পাহাড় কাটা তার ওপর পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। এযেন উভয় সংকটের মতোই উভয় ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। আর এই চিত্র দেখা গেছে এলজিইডি কর্তৃক বান্দরবান-চিম্বুক সড়ক থেকে হাতিভাঙ্গা ত্রিপুরাপাড়া পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে।
জানা যায়, বান্দরবান-চিম্বুক সড়ক থেকে হাতিভাঙ্গা ত্রিপুরাপাড়া পর্যন্ত ৭৫৫ মিটার সড়কটি ২০১৬ সালে ইটের সলিং করে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ। তখন পাহাড়ের ছয় ফুট পর্যন্ত অংশ কাটা পড়ে। এবার নতুন করে আরো নয় ফুট বেশি পাহাড় কেটে একই সড়ক পুনরায় নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। আবার পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর ও জলাধার।
দেখা যায়, হাতিভাঙ্গাপাড়া যাওয়ার সড়কটির প্রথম বাঁকে অপরিকল্পিতভাবে প্রায় ৯০ ডিগ্রি খাড়া করে এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কাটা হচ্ছে, যা আগের কাটা অংশ থেকে আরো সাত ফুট গভীর। অর্থাৎ বর্তমানে ১৩ ফুট নিচু করে পাহাড় কাটা হয়েছে। খাড়াভাবে পাহাড় কাটার ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে একটি ভবন ও দুটি ট্রান্সফরমারসহ বিদ্যুতের কয়েকটি আরসিসি খুঁটি। পাহাড় কাটার মাটি ট্রাকে করে নিয়ে হাফেজঘোনা নতুন বাসস্টেশন ঘেঁষে প্রবাহিত ছড়ার পাশে, মেম্বারপাড়ার জলাধারে ফেলা হচ্ছে।
এদিকে বান্দরবান-কেরানীহাট (কেবি) সড়ক থেকে বান্দরবান হিল রিসোর্ট ও হাফেজঘোনা হিন্দু মন্দির পর্যন্ত ৩৫৫ মিটার দৈর্ঘ্যের আরেকটি নতুন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বান্দরবান পৌরসভা। পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডে এ সড়ক নির্মাণের জন্যও অবাধে কাটা চলছে পাহাড়। মেসার্স মমিনুল হক জেভি (জয়েন্ট ভেঞ্চার) ইউটিমংয়ের নামে পাওয়া কাজটি বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদার উজ্জ্বল কান্তি দাশ।
যেভাবে দিন-রাত অবিরাম কাটা হচ্ছে, তাতে এ বছর আর এ পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। একই সাথে পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে পুকুর জলাধার ভরাট করার ফলে প্রকৃতিতে দেখা দিতে পারে বিরুপ প্রতিক্রিয়া।
জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড (সিএইচটিডিবি) বান্দরবানে রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রায় ২০টি পাহাড় কেটেছে। গত প্রায় এক বছর ধরেই বান্দরবানে পাহাড় কাটার এই মহোৎসব চললেও পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন কেন তা বন্ধের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, সেই প্রশ্ন সর্বত্র। তবে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাহাড় কাটা এবং পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে পুকুর ভরাট করার কাজে জড়িত থাকায় জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
২০০০ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করেছে। আইনে বলা আছে, অনুমোদন ছাড়া পাহাড় কাটার জরিমানা প্রথম অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। পরবর্তী অপরাধে জরিমানা দশ বছরের কারাদণ্ড, দশ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর দায়িত্ব শেষ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং পাহাড় ধ্বংসকারীদের আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। জরিমানা ছাড়াও পাহাড় বেষ্টনী দিয়ে বনায়ন করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সেগুলোতে একই অপরাধ বারবার হলে শাস্তির মাত্রা কয়েক গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পরিবেশ আইনে যদি এমন দুর্বলতা থাকে, তাহলে তা দূর করা এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ দ্রুতই পাহাড়শূন্য হয়ে যাবে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল বলে কিছু থাকবে না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যেখানে পাহাড় কাটা নিরোধে সরকারের ভূমিকা থাকা উচিত সেখানে সরকার খোদ পাহাড় কাটায় হাত বসিয়েছে। এতে পাহাড় কাটা দস্যুদের বিচার প্রক্রিয়াতেও দেখা দিতে পারে ধোঁয়াশা। পাহাড় কাটা প্রতিযোগিতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জড়িয়ে পড়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড় কাটা নিরোধে আইনের কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে। একই সাথে পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে পুকুর ভরাট করারও ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, সরকারের উচিত এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা। নইলে দেশ থেকে একদিকে পাহাড় বিলুপ্ত হবে অন্যদিকে মিলিয়ে যাবে পুকুর জলাধার। যার ফলে প্রকৃতিতে দেখা দিতে পারে বিরুপ প্রতিক্রিয়া।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ