বান্দরবানের লামা উপজেলায় ৩৯ পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে। সেখানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান পাহাড়িদের জুমের ফসল পুড়িয়ে দিয়েছে, ঝিরির পানিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে এবং পেটোয়া বাহিনী দিয়ে পাহাড়িদের মারধর করেছে।
আজ বুধবার দেশের ৩৬ বিশিষ্ট নাগরিকের দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, স্থানীয় পাহাড়িদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। এসব তৎপরতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন নাগরিকেরা।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৭ এপ্রিল লামা উপজেলার লাংকমপাড়া, জয় চন্দ্র কার্বারিপাড়া ও রেংয়েন কার্বারিপাড়ার অধিবাসীদের সৃজিত জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই আগুনে প্রায় ১০০ একর জুমের ধান, বাঁশ, আম, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ পুড়ে যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত পাড়াগুলোর অধিবাসীদের অভিযোগ, জমি দখলের জন্য লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির লোকজন তাদের ফসলে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের উপপরিচালককে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি লিজ বাতিলসহ ছয় দফা সুপারিশ জমা দিলেও তা কার্যকর করা হয়নি। বরং ৬ সেপ্টেম্বর আদিবাসীদের পানির একমাত্র উৎস পাহাড়ি ঝিরির পানিতে বিষ মেশানো হয়।
এর ফলে স্থানীয় পাহাড়িরা এ ঝিরির পানি পান করতে পারছেন না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসন অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
বিবৃতিদাতারা বলেন, কোম্পানির লোকেরা ১ সেপ্টেম্বর লাংকম ম্রোসহ চারজন ম্রো ব্যক্তির চাষ করা খেত থেকে ২৫ মণের বেশি মিষ্টিকুমড়া লুট করে নিয়ে যান। সর্বশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর রেং ইয়ুং ম্রোর বাগানে রোপণ করা ৩০০ কলাগাছ কেটে দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা থানায় মামলা করতে ভয় পান। কারণ পুলিশ বা প্রশাসন এতগুলো ঘটনার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত পাহাড়িদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ বেশ তৎপরতা দেখালেও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়িদের জমি দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং প্রতি পরিবারকে মাত্র পাঁচ একর জায়গা নিয়ে বাকি জায়গা রাবার কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আদিবাসীরা সংগত কারণেই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়িদের জমি দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং প্রতি পরিবারকে মাত্র পাঁচ একর জায়গা নিয়ে বাকি জায়গা রাবার কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আদিবাসীরা সংগত কারণেই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দাবি করেছে, তাদের নামে ১ হাজার ৬০০ একর সম্পত্তি লিজ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমি তারা দখলে রেখেছে, যা সাধারণ পরিদর্শনে স্পষ্ট হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অংশীদারের সংখ্যা ৬৪ জন। যা কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এবং অফিস অব দ্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের কোম্পানির নিবন্ধনসংক্রান্ত নীতিমালার লঙ্ঘন। বান্দরবান জেলা পরিষদের গঠিত কমিটির ২৯ মের রিপোর্টে লিজকৃত জমিতে ২৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো রবারগাছ রোপণ করা হয়নি উল্লেখ করে লিজ বাতিলের যে সুপারিশ করেছে, তা এখনো প্রতিপালিত হয়নি। ৬৪ জন অংশীদারের মধ্যে বেশ কয়েকজন আগে বান্দরবান জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। ফলে লিজ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্পষ্ট। শুধু তা–ই নয়, তাদের মধ্যে কয়েকজনের পরিবারের একাধিক সদস্য ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ২৫ একর করে ভূমি লিজ পেয়েছেন। সরকারি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কী বিবেচনায় তারা এ সম্পত্তি লিজ পেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। বরং এমন বরাদ্দ ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেআইনি বলে প্রতীয়মান।
বিবৃতিতে তিন দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে ম্রো এবং ত্রিপুরা আদিবাসীদের ভূমিসহ সব আইনি ও প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, প্রতারণামূলকভাবে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেওয়া লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লিজ বাতিল, দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা এবং লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সুলতানা কামাল, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পারভীন হাসান, খুশী কবির, আনু মুহাম্মদ, জেড আই খান পান্না, ইফতেখারুজ্জামান, রানা দাশগুপ্ত, সুব্রত চৌধুরী, কাজল দেবনাথসহ আরো অনেকে।
এদিকে বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের তিন পাহাড়ি গ্রামের জনগোষ্ঠী যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে নজর রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বান্দরবান জেলা প্রশাসকে বলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়া আগুনের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলেছে।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর কমিশন এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, গত ২৬ এপ্রিল সংঘটিত বান্দরবানের লামা উপজেলা লংকম কারবারি পাড়া, রেংয়েন কারবারি পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কারবারি পাড়ার প্রায় ৩৫০ একর জুমচাষের প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেওয়া, ঝর্ণা বিনষ্ট করা ও পরবর্তী সময়ে এর ফলে সৃষ্ট খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাবে তিনটি গ্রামের মানুষের অত্যাধিক কষ্টে জীবনযাপনের বিষয়ে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খাদ্য সংকটের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ লতাগুল্ম খেয়ে রয়েছেন বলেও জানা যায়।
এর পরেও স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ওপর হয়রানি অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী তিন গ্রামের অধিবাসীরা।
কমিশন আরও উল্লেখ করেছে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দীর্ঘদিন থেকে ওই এলাকার ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়দের নামে মামলা দিচ্ছে।
কমিশন উল্লেখ করেছে, স্থানীয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে বলা হলেও, তা পর্যাপ্ত নয়। ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবারকে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গৃহনির্মাণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বলা হয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভুক্তভোগীরা যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলার পুলিশ সুপারের প্রতি আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, “এরশাদ, বিএনপি সরকার আমলেও এতটা ছিল না। যতটা না এখন পাহাড়িদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলানো শুরু হয়েছে। এভাবে চললে সরকারের ভাবমূর্তি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪১
আপনার মতামত জানানঃ