প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নিরাপদ কাজের অবস্থা এবং ন্যায্য বেতনের লড়াইয়ে এখনো জয়ী হওয়া যায়নি বলে সতর্ক করে দিয়েছেন অধিকার আদায়ে সংগ্রামী লোকজন। রানা প্লাজা ভবনের মালিক কারাগারে রয়ে গেছেন। কিন্তু, তিনি এবং কারখানার মালিক ও স্থানীয় কর্মকর্তাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে হত্যার যে বিচার চলছে, অভিযোগ আনার পর থেকে প্রায় সাত বছর ধরে সেটি চলমান। এখনো কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তাছাড়া, এখনো শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়া হয় না এবং শ্রমিক সংগঠন করলে হয়রানির শিকার হতে হয়।
সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২ হাজার ৪৩৮ জনকে৷ মোট পাঁচটি পোশাক কারখানায় পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিক কর্মরত ছিলেন৷ নিহতদের মধ্যে ২৯১টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়৷ যারা প্রাণে বেঁচে যান তারা পঙ্গুত্ব নিয়ে এখন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। যদিও সময় সারিয়ে তোলে সব ক্ষত। অভ্যস্ত হয়ে যায় মানুষ। তাই হয়তো রানা প্লাজা ধসের ঘটনাও আজ অনেকটাই স্মৃতির তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যা আছে তা শুধু স্মরণ করার আনুষ্ঠানিকতা। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা পাইনি সরকারের সাহায্য। মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা। ৯২ শতাংশ শ্রমিক সরকার থেকে ন্যূনতম সাহায্যও পায়নি এই মহামারির সময়টাতে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দশ বছর
২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ‘রানা প্লাজা’ নামে পরিচিত একটি বহুতল ভবন ধসে পড়লে ভবনটিতে অবস্থিত পোশাক কারখানায় কর্মরত প্রায় ১২০০ শ্রমিক নিহত এবং প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক আহত হয়েছিলেন।
সারা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম এই ‘শিল্প দুর্ঘটনা’র নেপথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে এটি ব্যবহার না করার সতর্কবার্তা থাকলেও সেটি উপেক্ষা করা হয়েছিল। তাছাড়া, ভবনের স্থান নির্বাচন, নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল দুর্নীতি। রানা প্লাজা ধসে বিপুলসংখ্যক পোশাক শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনায় সারা দুনিয়ার নজর পড়ে বাংলাদেশের ওপর।
ভবন মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পুলিশ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোট পাঁচটি মামলা দায়ের করে। তবে এত প্রাণহানির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার শেষ হয়নি ১০ বছরেও। উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর গত বছর মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এরপর বিচারে কিছুটা গতি এলেও মামলার মূল আসামি সোহেল রানা কিছুদিন আগে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। অবশ্য, আপিল বিভাগে ওই জামিন স্থগিত থাকায় এখনো তিনি মুক্ত হননি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১০ বছর উপলক্ষে বিশ্ব গণমাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএন এ প্রকাশিত ‘রানা প্লাজার ১০ বছর পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কি নিরাপদ?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পোশাক কারখানা বিপর্যয়ের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল।
এগারশো জনেরও বেশি মানুষ সেদিন নিহত হয়েছিলেন, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন নারী। এর পাশাপাশি আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনার একদিন আগে ভবনটির কাঠামোতে ফাটল ধরা পড়লে নিচের তলাগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করা হয়েছিল।
কিন্তু ‘পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিককে (ঘটনার দিন) সরাসরি তাদের ঊর্ধ্বতনরা কাজে ফিরে আসতে বাধ্য করেছিলেন। নয়তো একদিনের মজুরি পাওয়ার জন্য তাদের ওপর পরোক্ষভাবে যে চাপ ছিল তা তাদের বাধ্য করেছিল উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়েও কাজে ফিরে আসতে।
কেন ধসে পড়েছিল?
বাংলাদেশে গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার সিএনএনকে বলেন, ‘শ্রমিকদের আসলে বলার কিছু ছিল না কারণ তারা ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করছিল…এমনকি তারা ইউনিয়নভুক্তও ছিল না। সুতরাং, তারা সম্মিলিতভাবে (কাজে না ফেরার) বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেনি।’ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর চালু হওয়া ডিজেল জেনারেটরগুলো থেকে সৃষ্ট কম্পনের ফলে ধসের সূত্রপাত হয়েছিল?
কিন্তু পরবর্তী তদন্তে ব্যর্থতা ও তদারকির অভাবের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। বৈশ্বিক অলাভজনক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থার মতে- সাত বছর পুরনো ভবনটির পুরো সময়টার প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই ছিল দুর্নীতি। রানা প্লাজা ধসে পড়ে কারণ একটি ভরাট করা পুকুরের জায়গায় নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল এবং অনুমোদিত নকশার বাইরে জায়গা বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত মেঝে যুক্ত করা হয়েছিল।
এটি ধসে পড়ে কারণ কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনার অনুমতি দিয়ে এটিকে শিল্পখাতে রূপান্তরিত করার অনুমতি দিয়েছিল এবং ভবনটি অতিরিক্ত পাঁচটি পোশাক কারখানার দখলে ছিল।
এটি ধসে পড়ে কারণ আগের অডিটগুলো পর্যাপ্ত ছিল না; সতর্কতাসমূহ উপেক্ষা করা হয়েছিল কিংবা পাত্তাই দেয়া হয়নি।
পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনা
রানা প্লাজার ঘটনার পর অনেক ব্যবস্থা নেয়া হলেও বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪%-ই আসে যেই পোশাক কারখানাগুলো থেকে এক দশক পর এসে সেগুলো কি নিরাপদ?
এমন প্রশ্ন রেখে সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়: এটা বলা যায় না যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দুর্ঘটনামুক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) জানিয়েছে যে, রানা প্লাজা ধসে পড়া থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে কমপক্ষে ৩৫টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭ জন মারা গেছে। তাদের মধ্যে একটি ছিল বয়লার বিস্ফোরণ। ২০১৭ সালের ওই ঘটনায় ১০ জন মারা গিয়েছিল।
বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের দুর্দশা
২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্যোগের পর অবিলম্বে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার পোশাক শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন প্রতি মাসে ৩,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৫,৩০০ টাকাতে উন্নীত করে। পাঁচ বছর পর সেটি আবার বেড়ে ৮,০০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও গ্লোবাল ইউনিয়ন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ এর তিনগুণ বেতন দাবি করে বলছে যে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশের কারখানার শ্রমিকরা (বেঁচে থাকতে) হিমশিম খাচ্ছেন।
শ্রমিকরা সিএনএনকে জানান, নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা নিজেদের এখন অনেকটা নিরাপদ মনে করলেও কর্মস্থলের পরিবেশ নিশ্চিতে এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত।
‘বাংলাদেশে রানা প্লাজা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা ১০ বছর ধরে বেকারত্বের শিকার’ শীর্ষক জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: রানা প্লাজা ধসের সময় পঞ্চমতলায় একটি কারাখানার সিনিয়র অপারেটর শিলা বেগমের ওপর একটি বড় বিম এসে পড়ে। এর ফলে, তার ডান হাত সারা জীবনের জন্য অকেজো হয়ে যায়, মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়ও ভেঙে যায়। এখন এই ‘সিঙ্গেল মাদার’ তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের জন্য বই কিনতে পারছেন না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তার পাকস্থলী থেকে এখন টিউমার অপারেশন করে সরাতে হবে।
শিলা বলেন, রানা প্লাজা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো তিলে তিলে মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার জন্য ভবন নির্মাণে দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে বলা প্রতিবেদনে বলা হয়: চলতি মাসে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে, রানা প্লাজা থেকে বেঁচে যাওয়া ৫৪.৫% মানুষ আজও বেকার। তাদের মধ্যে ৮৯% গত পাঁচ থেকে আট বছর ধরে কর্মহীন, আর ৫.৫% গত তিন থেকে চার বছর ধরে বেকার।
অ্যাকশনএইড এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্য তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা তাদের সেরে ওঠা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভে তাদের সহায়তা করার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার ওপরই জোর দিচ্ছে।’
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় নিলুফা বেগম (৪২) একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ডের শার্ট সেলাই করছিলেন। তিনি তার ডান পায়ে আঘাত পেয়েছেন যার জন্য ১১টি বড় অপারেশন প্রয়োজন। তার বাম হাতও আর কাজ করে না। তিন বছর আগে তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
সম্প্রতি তার স্বামী পরিবার পরিত্যাগ করার পর নিলুফা এখন তার ১৬ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে রানা প্লাজার কাছের রাস্তায় একটি সিগারেটের দোকান চালান। ছেলেটি পেশাদার ড্রাইভারের সার্টিফিকেট পাওয়ার চেষ্টা করছে। নিলুফা নিক্কেই এশিয়াকে বলছিলেন যে, তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে ২৭০০ ডলার পেয়েছেন যার বেশির ভাগই তার চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হয়েছে। তার মতে, ‘জীবন বড় বেদনাদায়ক।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ