সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার নয় বছর পূর্ণ হচ্ছে রবিবার (২৩ এপ্রিল)। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এগোয়নি। এতগুলো প্রাণহানির ঘটনায় সোহেল রানারও বিচার হয়নি।
আজও আহত ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হয়নি ক্ষতিপূরণ। করা হয়নি চিকিৎসার ব্যবস্থা। শুধুমাত্র রানা প্লাজা নয়, তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ভবন ধসসহ এ পর্যন্ত দেশের যেসব গার্মেন্টেসে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি।
করোনায় বেড়েছে আহত শ্রমিকদের দুর্দশা
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক জরিপে জানা যায়, করোনায় দেশের শিল্প খাতের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ৫৭ শতাংশ বেকার হয়ে পড়েছেন এবং এই ক্ষতিগ্রস্তদের করোনায় ৯২ শতাংশ সরকারের কোনো সহযোগিতাও পাননি। ফলে এ সময় তাদের চরমভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে এবং আয় কমেছে।
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এই ৯ বছরেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি, অনেকেরই হয়নি কর্মসংস্থান। যাদের অবহেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তাদেরও শাস্তি নিশ্চিত হয়নি।
এদিকে জরিপে আরও বলা হয়েছে, এখনো ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্য অবনতির দিকে রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৮.৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্য মোটামুটি স্থিতিশীল এবং ২৭.৫ শতাংশ সম্পূর্ণ স্থিতিশীল রয়েছে।
১৪ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগই মাথা ব্যথা, হাত ও পায়ে ব্যথা, কোমর ব্যথা এমন বড় সমস্যা নিয়ে জীবন যাপন করছেন ।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কাজে থাকা ৪৩ শতাংশ শ্রমিকের ১২ শতাংশ পোশাক কারখানা, ১২ শতাংশ দর্জি, ৩ শতাংশ কৃষিকাজ, ২.৫ শতাংশ দিনমজুরি, ২ শতাংশ গৃহকাজ, সাড়ে ৩ শতাংশ বিক্রয়কর্মী এবং ৭ শতাংশ অন্যান্য কাজ করেন।
আহত পোশাক শ্রমিকদের সাড়ে ৯ শতাংশের কোনো আয় নেই। সাড়ে ১০ শতাংশের আয় ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে। সাড়ে ৩৭ শতাংশ আহত শ্রমিকের আয় ৫ হাজার ৩০০ থেকে ১০ হাজার ৩০০ টাকা। সাড়ে ২৯ শতাংশ শ্রমিকের আয় ১০ হাজার ৩০১ থেকে ১৫ হাজার ৩০০ টাকা। এর বেশি আয় ১৩ শতাংশের।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সাহায্য না পাওয়ায় করোনা মহামারিতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে আছে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা।
সব হারিয়ে বেঁচে আছে তারা
সেদিন ভবন ধসে মেরুদণ্ডে আঘাত পান মো. সোলায়মান। সোলায়মান কাজ করতেন রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ স্টাইল নামের পোশাক কারখানায়।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে এনাম মেডিক্যাল ও সিআরপিতে চিকিৎসা নেওয়ার পর আর চিকিৎসা নিতে পারিনি।
ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা পেয়েছি তা দিয়ে কোনো রকমে চিকিৎসা করিয়ে, পরিবারের জন্য খরচ করে সবই শেষ। তারপর ধারদেনা করে চলছে। ওই সময় সরকার ও মালিকরা স্থায়ী চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেউ এখন খবর রাখে না।
রানা প্লাজায় আহতদের মধ্যে একজন রেবেকা বেগম। বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামে। রেবেকা ৯ বছর আগের আজকের দিনে হারিয়েছেন মা, দুই দাদি, দুই চাচা ভাই ও বোনকে। একইসঙ্গে হারিয়েছেন নিজের দুটি পা।
রেবেকার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান। মেয়ে মিজরাতুল মুনতাহা (৬) ও ছেলে মাদানি আন নূর (২)।
রেবেকা বেগম বলেন, ‘রানা প্লাজা পোশাক কারখানায় আমিসহ আমার দুই দাদি, মা, দুই চাচাতো-ভাইবোন ও এক ফুফু শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। হঠাৎ করেই ওই ভবনে ফাটল দেখা যায়। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে বলা হলেও কর্তৃপক্ষ সেদিকে গুরুত্ব দেয়নি। তোমরা কাজ করতে এসেছো, কাজ করো, না হলে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হবে। চাকরি হারানোর ভয়ে হাজারো শ্রমিকের মতো আমরাও কর্মে চলে যাই।’
‘কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই ভবনটি ধসে পড়ে। তারপর আর কিছুই বলতে পারি না। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার দুই পা ভবনের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমার আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কর্মীরা আমার কাছে ছুটে এসে আমার স্বামীর সহযোগিতায় উদ্ধারকর্মীরা আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে আমার দুই পা কেটে ফেলে। এখন পর্যন্ত আটবার আমার পা কাটতে হয়েছে। আবারো হাড্ডি বৃদ্ধি পাওয়ায় অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। আবারো হাড্ডি কাটতে হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।’
‘আমার মা, দুই দাদি এবং দুই চাচাতো ভাই বোন আর বেঁচে নেই। শুধু আমি আর আমার ফুফু বেঁচে যাই। সব সময় আমার চোখের সামনে স্বজনদের মুখগুলো ভেসে ওঠে। ওই দুর্ঘটনায় শরীরের দুটি অঙ্গ হারানো শ্রমিকদের ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হলেও আমি পেয়েছি ১০ লাখ টাকা।’
মো. মনির হোসেন রানা প্লাজার চার তলায় ফ্যান্টম টেক গার্মেন্টসে চেকিং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন৷ রানা প্লাজা ধসের তিন দিন পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তিনি ভিতরে চাপা পড়ে ছিলেন৷ মাথায় গুরুতর আঘাত পান। হাত-পাও গুরুতর জখম হয়৷
এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি৷ চিকিৎসা প্রয়োজন, তাও পাচ্ছেন না৷ দুই সন্তান এবং স্ত্রী-কে নিয়ে তার সংসার৷ কোনো কাজ পাননি এখনো৷ সাভারের রাজাসন এলাকায় মোবাইল ফোনের ফ্লেক্সিলোড করে টিকে আছেন৷ সন্তানদের পড়াশুনার খরচ জোগাতে পারেন না৷ ঘরভাড়া মাসের পর মাস বাকি৷ ঠিকমতো খাবারও জোটে না৷
মনির হোসেন বললেন, ‘একবার পেয়েছিলাম ৪৫ হাজার টাকা৷ আর পরে পেয়েছি ৫০ হাজার টাকা৷ আর কোনো সহায়তা পাইনি৷ কাজতো করতে পারি না, ভয় পাই৷ মনে হয় ভেঙে পড়বে৷’
রানা প্লাজার পাঁচ তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে নিলুফার বেগম সুইং অপারেটরের কাজ করতেন৷ রানা প্লাজা ধসে তার ডান পা হারিয়েছেন৷ স্বামী আছে৷ আছে এক সন্তান৷ সাভারে থাকেন৷ সর্বমোট তিন লাখ ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন৷ সাভারে চা বিক্রি করেন৷ কোথাও কোনোও কাজ পাননি৷
তিনি জানান, ‘আমি তো পঙ্গু, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারি না৷ কাজ করব কীভাবে, কে কাজ দেবে? এখন আবার কিডনির সমস্যা ধরা পড়েছে৷ স্বামীর ওপর ভর করে আছি৷’
তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ যদি আমাকে একটু সহায়তা করত, তাহলে আমার এই অবস্থা হতো না৷ ভালো কোনও কাজ করতে পারতাম৷’
এসডব্লিউ/এসএস/২২০৭
আপনার মতামত জানানঃ