সাড়ে পাঁচ বছর আগে প্রাথমিক পরিদর্শনে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও ট্রেড ইউনিয়নের একটি জোট- অ্যাকর্ড বাংলাদেশের দেড় হাজার পোশাক কারখানায় নিরাপত্তাজনিত ত্রুটির সন্ধান পায়। কিন্তু সেসব ক্রটির সংস্কারকাজ করতে গড়িমসি করেন কারখানার মালিকেরা। তখন সংস্কারকাজে গতি আনতে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি প্রাপ্যতা (ইউডি) ও কারখানার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
যদিও বন্ধ, স্থানান্তরসহ নানা কারণে ত্রুটিপূর্ণ কারখানার সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে সাড়ে ছয় শতে নেমেছে। জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে থাকা এই কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ কচ্ছপগতিতে চলার কারণে রানা প্লাজা ধসের আট বছর পরও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। আদৌও করা যাবে কি না তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
কারণ, মহামারি করোনার অজুহাতে অধিকাংশ কারখানা মালিকই এখন সংস্কারকাজে নতুন করে অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। তা ছাড়া সরকার কিংবা বিদেশি ক্রেতাদেরও এ নিয়ে তেমন চাপ নেই। ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এ দেশ থেকে কার্যক্রম গোটানোর কারণে মাঝারি ও বড় প্রায় দুই হাজার কারখানার সংস্কারকাজেও ধাক্কা লেগেছে। কারখানাগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি ত্রুটি সংশোধন করা হলেও বাদবাকি কাজ কবে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের সেফটি শাখার যুগ্ম মহাপরিদর্শক ফরিদ আহাম্মদ বলেন, তারা কাজ করছেন কিন্তু এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় পৌছানো যায়নি। কাজ হচ্ছে কিন্তু সন্তুষ্টির পর্যায়ে যায়নি। পজেটিভ কাজ হচ্ছে এবং অনেকগুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সন্তুষ্ট এখনই বলা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালের পর আনুমানিক ১৫০০ কারখানাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। এখন সেগুলোর পর্যালোচনার কাজ চলছে। এজন্য কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য অনেক জনশক্তির দরকার বলে উল্লেখ করেন ফরিদ আহাম্মদ।
রানা প্লাজা ধসের পর আমাদের যেসব আরএমজি কারখানা আছে ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ-অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স এর মাধ্যমে সেগুলো এসেসমেন্ট করা হয়। সরকারের সাথে আইএলওর ফান্ডের একটা প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা ১৫৪৯টি কারখানা এসেসমেন্ট করি। সেটা নিয়ে এখন আমরা কাজ করছি। তিনি বলেন, এর মধ্যে ৭০০ কারখানা চালু আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলোর উপরে আমরা কাজ করছি। এখানে আমাদের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ।
রানা প্লাজা ধসের পর কল-কারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং আবাসিক ভবনের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কিন্তু সরকারের এই অধিদপ্তর বলছে এত ভবন নির্মাণের আগে এসবের নিরাপত্তার জন্য নকশা পাশ করাসহ নানা দিক রয়েছে, যেগুলো সরকারের কয়েকটি সংস্থায় করা হয়।
দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল সাভারের রানা প্লাজার ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া দেশের সবচেয়ে বড় এই শিল্প দুর্ঘটনার আট বছর পূর্ণ হয় শনিবার। তবে সংস্কারকাজ না করায় পোশাকশিল্পের নিরাপত্তার গলার কাঁটা হয়ে আছে সাড়ে ছয় শ কারখানা। তার বাইরে আট বছরেও ৬৫৪ কারখানাকে পরিদর্শন কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কারণ, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য না হওয়ায় কারখানাগুলোর দায়িত্ব কেউ নেয়নি। ধসে যাওয়া রানা প্লাজায় পাঁচটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোশাক কারখানা ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৈরি পোশাকশিল্পের একজন মালিক বলেন, ‘ব্যবসা হারানোর চাপে পড়ে মাঝারি ও বড় কারখানার মালিকেরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে সংস্কারকাজ করেছে। ছোটরা সেই কাজ করেনি। এতে করে যেটি হয়েছে, আমরা কেউ ঝুঁকিমুক্ত হতে পারিনি। নতুন করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো পোশাকশিল্প আবারও ভয়াবহ বিপদে পড়বে। সংস্কারকাজের যেটুকু অর্জন সেটুকু বিফলে যাবে।’
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে পাঁচ বছরের জন্য ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। তারা দুই হাজারের বেশি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত করে। আর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বাইরে থাকা কারখানাকে সংস্কারকাজের আওতায় আনতে এনটিএপির অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) পরিদর্শন কাজ করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বে ও ডিআইএফইর তত্ত্বাবধানে গঠিত সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি) কারখানাগুলোর দেখভাল করছে।
অ্যাকর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের ক্রেতাদের এই জোটের পরিদর্শন ও সংস্কার কার্যক্রমের অধীনে ছিল ১ হাজার ৬২৯ কারখানা। গত বছর অ্যাকর্ড যখন বাংলাদেশ ছাড়ে তখন কারখানাগুলোর অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটির ৯২ট শতাংশ সংশোধনকাজ শেষ হয়। আর ২৭৯টি কারখানা প্রাথমিক পরিদর্শনে পাওয়া সব ত্রুটি সংশোধন করেছিল। আরএসসি দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত কারখানাগুলোর ত্রুটি সংশোধন ১ শতাংশ বেড়েছে। আর সব ত্রুটি সংশোধন সম্পন্ন করা কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫৯। তবে ১ হাজার ২৪৩টি কারখানায় মানসম্মত অগ্নিশনাক্তকরণ ও ফায়ার অ্যালার্ম যন্ত্র বসানো হয়নি। ৩৭৫টি কারখানার কাঠামোগত সংস্কারকাজ বাকি রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পোশাকশিল্পে অগ্নিদুর্ঘটনা ও বিস্ফোরণের ঘটনা বাড়তে শুরু করেছে। এসব ঘটনায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স থাকার সময়ে কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার যে অগ্রগতি হয়েছিল, তাতে শিথিলতা চলে এসেছে। তারা বলেন, পোশাক কারখানার নিরাপত্তায় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২০৫৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ