সূর্য আর তার আলো। মানব জীবনের এক অনন্য প্রভাবক। এই সূর্যকে যদি বাতির মত সুইচ টিপে নিভিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীবাসীর সেটা জানতে লেগে যাবে পাক্কা ৮ মিনিট। মানে, পৃথিবীর যে পাশে সূর্যের আলো পড়ছিলো, আরো ৮ মিনিট ধরে সেই পাশ আলোকিত হয়ে থাকবে।
অনেকের কাছে ব্যাপারটা ধাক্কার মত আসে। দৈনন্দিন জীবনে তো এমন কিছু ঘটে না। লাইট জ্বালালেই দুম করে আলো জ্বলে ওঠে, একদম সাথে সাথে। লাইট নেভালে তো ৮ মিনিট পরে নেভে না। তাহলে, সূর্যের আলো এরকম ধোঁকাবাজি কেন করবে?
উত্তরটা সরল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেণ্ডের মত সময় লাগে। আলোর গতি অনেক, কিন্তু অসীম না। আলোর সেই গতি প্রথমবার কিভাবে বের করা হয়েছিলো? কে করেছিলো?
চলুন জানা যাক, আলোর গতি কীভাবে বের করা হয়েছিলো! কোনো জটিল হিসেব-নিকেশে যাবো না। শুধু গল্পটা বলার চেষ্টা করবো।
মহাবিশ্বে সবকিছু বেশ নিয়ম মেনে চলে। যেমন, পৃথিবী তার নিজ অক্ষের ওপর প্রায় ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে আসে। এজন্য ২৪ ঘণ্টায় দিন-রাত হয়। কখনো ২৬ ঘণ্টা বা কখনো ২২ ঘণ্টা, এরকম হয় না।
পৃথিবীর কক্ষপথ দেখতে কেমন, কেন এমন, নিউটন তো এইসব নিয়মগুলো পর্যবেক্ষণ করে সেরা সেরা কিছু সূত্র দিয়ে দিলেন। সেগুলো দিয়ে সুন্দরমত মহাকর্ষ ব্যাখ্যা করা গেলো। অমুক ভরওয়ালা কোনো বস্তু তমুক ভরওয়ালা কোনো বস্তুর চারপাশে কিভাবে, কত গতিতে, কতক্ষণে ঘুরবে, এগুলো আগের চেয়ে অনেক সূক্ষ্মভাবে হিসাব করা গেলো।
যেমন ধরুন, চাঁদ মামা ঠিক কোন সময়ে পৃথিবীর কক্ষপথের কোথায় থাকবে, সেটার হিসাব নিখুঁতভাবে করা গেলো।
গোল বাঁধলো বৃহস্পতির চাঁদ নিয়ে, আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চাঁদগুলোর (একাধিক) কক্ষপথ নিয়ে। নিউটন সাহেবের হিসাব বলছে, চাঁদগুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘোরার অমুক সময়ে পৃথিবী থেকে চাঁদগুলোকে অমুক জায়গায় দেখা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, ঘটনা সেভাবে ঘটছে না।
কোনো কোনো সময় একদম টাইমমত চলে আসে, কখনো সময়ের ৮ মিনিট আগেই চলে আসে, আবার কখনো ৮ মিনিট পরে আসে। নিউটন ব্যাটা কি তাহলে ভুল করলো?
ডেনমার্কের জ্যোতির্বিদ ওলে রয়মার (Ole Rømer) ১৬৭৬ সালে দেখলেন, কাহিনীতে আরেকটা তথ্য যোগ করার দরকার। শিডিউলের (মানে, হিসেব করে বের করা সময়ের) আগেই চাঁদগুলোকে দেখা যায়, যখন বৃহস্পতি ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে।
আর শিডিউলের পরে আসে, যখন বৃহস্পতি পৃথিবীর চেয়ে দূরে থাকে। তিনি আসল পর্যবেক্ষণটা করেছিলেন বৃহস্পতির একটা চাঁদ আইয়ো (IO)-এর চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে। সেই সময় তিনি অদ্ভুত একটা দাবি করলেন – যেখানে ঘটনাটা ঘটে, সেখান থেকে পৃথিবীতে ঘটনাটা পৌঁছাতে একটু সময় লাগে।
কতটুকু দূরে থাকলে কতটুকু সময় লাগে, সেই হিসেব থেকে তিনি তখনকার যুগের সবার চোখ কপালে তুলে দেয়ার মত একটা প্রস্তাব করলেন। আর তা হলো, আলো জিনিসটার গতি অসীম না, তারও একটা গতি আছে। আর সেই গতিটা হলো, সেকেন্ডে ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার।
যারা আসল গতিটা (সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার) জানেন, তারা চ্যাঁচামেচি শুরু করার আগেই জানিয়ে দিচ্ছি, আলো নিশ্চয়ই তখন ভিন্ন গতিতে চলতো না। ওনার দাবিটা আসল গতির চেয়ে ২৬% কম ছিলো।
কারণ সোজা। তিনি হিসেবে কিছু ভুল করেছিলেন। ভুল বলাটা আসলে ঠিক হবে না। আসলে তখন যে যন্ত্রপাতি ছিলো, সেগুলো দিয়ে উনি যতটুকু হিসেব করতে পেরেছিলেন, সেটাই করেছেন। এরপর আস্তে আস্তে যন্ত্রের সংবেদনশীলতা বেড়েছে, আরো নিখুঁত হয়েছে। এবং আমরাও পেয়েছি আলোর বেগের সূক্ষ্ম হিসাব।
যে বিজ্ঞানী প্রথমবার এই আবিষ্কারটা করলেন, তাকে নিয়ে দুটো কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। ওলে রয়মার ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৬৪৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আধুনিক থার্মোমিটারের আবিষ্কারক।
শুধু তাই নয়, তার বানানো রয়মার স্কেলকে আরেকটু উন্নত করে ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট বানিয়েছিলেন ফারেনহাইট স্কেল। যারা “ফ্ল্যাশ” কমিকস পড়েছেন বা সিরিজটা দেখেছেন, তারা জানেন যে ফ্ল্যাশ ব্যাটা অনেক জোরে দৌড়ায়। পুরনো কমিকসে বেশ কয়েকবার সে নিজের গতিবেগ মেপেছে রয়মার ইউনিট দিয়ে, সেটা ওলে রয়মারের স্মরণেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ