প্রতিটি অপারেশন খুব সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়, কখনও কখনও কয়েক মাস সময় নিয়ে৷ টার্গেটের প্রতিটি কাজ বিশ্লেষণ করা হয় এবং বাংলাদেশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের ১৫টি ইউনিটের একটি তার উপর নজরদারি চালায়৷ ভিকটিমদের সাধারণত গভীর রাতে তুলে নেয়া হয় এবং বিশেষ এই পুলিশ বাহিনীর কার্যালয়ে বা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়৷
ডয়চে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেয়া দুই ব্যক্তিই আরো অনেক অভিযোগ করেছেন৷ তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক স্বার্থে এই অভিজাত বাহিনীকে ব্যবহার করেন৷ অভিযোগ রয়েছে, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে এসবের অনুমোদনও দেয়া হয়৷
লক্ষ্যবস্তু যদি রাজনৈতিক ব্যক্তি হয় তাহলে কেবল উচ্চপর্যায়ের সুস্পষ্ট অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতেই এটি বাস্তবায়ন করা হয়৷ সাক্ষাৎকার দেয়া এক ব্যক্তি বলেন, এসব ক্ষেত্রে ‘‘সিদ্ধান্ত সর্বনিম্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আসবে৷ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আদেশটা প্রদান করে থাকেন৷”
অন্য সাক্ষাৎকারদাতা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোনো নির্দেশ দিবেন বলে মনে হয় না৷”
বাংলাদেশের অভিজাত সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত, জানাচ্ছে ডয়চে ভেলে এবং নেত্র নিউজ এর এক নতুন অনুসন্ধান৷ র্যাবের সাবেক কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য থেকে ইঙ্গিত মিলে যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে র্যাবকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন থাকে।
শুধু তাই নয়, এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সরকার নানাভাবে পুরষ্কৃতও করে থাকে। যেমন, একরামুল হকের হত্যায় সরাসরি জড়িতদের মধ্যে যে তিনজন সামরিক কর্মকর্তাকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি তাদের মধ্যে একজনকে পরবর্তীতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনে পাঠানো হয়।
এই প্রসঙ্গে কর্মকর্তাদের একজন বলেন, “আমার দেখা মতে তো সবাই র্যাবে সার্ভ করে পিসকিপিং মিশনে চলে গেছেন।” এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন অপর কর্মকর্তাও।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাছে অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত ও লোভনীয় পদায়ন হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংগৃহীত ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সালে নির্বাচনের বছরে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে গিয়েছিল এবং সেই বছরই বাংলাদেশ সরকার “ওয়ার অন ড্রাগ” বা “মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করেছিল।
যেমন, ২০১৭ সালে অর্থাৎ নির্বাচনের আগের বছর। ১৫৫ জন মানুষ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ২০১৮ সালে বা নির্বাচনের বছরে এই সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বাড়ে। ওই বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৪৬৫ জন। নির্বাচন-পরবর্তী ২০১৯ সালে নিহত হন ৩৯১ জন। এই সংখ্যা ২০২০ সালে কমে ২২৩ জনে নেমে আসে।
বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী নূর খান এই ব্যাপারে বলেন, “জাতীয় নির্বাচন যখন আসে, বাংলাদেশে কিন্তু মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়।” তার বক্তব্য, গত দুইটি নির্বাচনের বছরের পরিস্থিতি থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে আগামী নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা যেকোন প্রকারে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বারবার অস্বীকার করে বলে আসছে যে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এই জবানবন্দী আরও একবার দেখিয়ে দিলো যে সরকারকে এসব অস্বীকার করা থামাতে হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা শুরু করতে হবে।”
এ বিষয়ে নেত্র নিউজ এবং ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের জবাব চাওয়া হয়।
ডয়েচে ভেলেকে পাঠানো এক জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “আপনারা নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ৩১টি ইস্যুর তালিকা পাঠিয়েছেন। আমরা প্রত্যেকটি ইস্যু মূল্যায়ন ও যাচাইবাছাই করেছি। আমরা দেখেছি যে, এসব ইস্যু অতিরঞ্জিত, ভিত্তিহীন ও অসত্য।”
২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত র্যাবের হাতে ৭ শতাধিক মানুষ বিচার-বহির্ভূতভাবে নিহত হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় দাবি করে, “এই ধরণের সংবাদ বানোয়াট, ভুয়া ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়। এই ধরণের যেকোনো অভিযোগ একজন স্বাধীন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন। সেসব তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ধরণের অভিযোগগুলো সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না।”
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পৃক্ততা টেনে ডয়েচে ভেলে ও নেত্র নিউজ যেসব প্রশ্ন পাঠিয়েছে, সেগুলো “শিষ্ঠাচার-বহির্ভূত ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা-বিরোধী”।
উল্লেখ্য, সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত এই বাহিনীকে নিয়ে কয়েক মাস ধরে ডয়চে ভেলের ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট এবং সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ যৌথ অনুসন্ধান চালিয়েছে৷ প্রতিষ্ঠার দুই দশক পর এই প্রথম এই বাহিনীতে কাজ করা দুই সদস্য এই ‘ডেথ স্কোয়াড’ এর ভেতরের তথ্য জানালেন৷
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল৷ তাদের পরিচয় এবং নিয়োগের ইতিহাস নিশ্চিত করা হয়েছে৷ কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের চিহ্নিত করা যায়, এমন সকল তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে৷
একজন হুইসেলব্লোয়ার জানিয়েছেন, র্যাব যদি জানতে পারে যে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাহলে তিনি যে বাহিনীতে কাজ করেছেন সেই বাহিনীই তাকে মেরে ফেলতে পারে৷
ডয়চে ভেলে তাদের স্বীকারোক্তির সত্যতা যাচাই করেছে এবং বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী এবং অন্যান্য সূত্র যেমন পুলিশ এবং পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন, বিভিন্ন মামলার তথ্যভাণ্ডার এবং একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ড যাচাই করার মাধ্যমে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে৷
এই দুই তথ্যদাতার দেয়া প্রতিটি তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি৷ দুজনেই জানিয়েছেন কাগজপত্রে কোনো প্রমাণ যাতে না থাকে, সেজন্য গোপন এই অপারেশনগুলোর দায়িত্ব দেয়া হতো মৌখিকভাবে৷
আলাদাভাবে নেয়া সাক্ষাৎকারে মূল বিষয়গুলো নিয়ে দুজনেই একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন৷ তাদের সাক্ষ্য থেকে পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি চিত্র পাওয়া যায়৷ অপহরণ থেকে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাগুলোকেও বলতে গেলে দায়মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়া হয়৷
এসডব্লিউএসএস/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ