জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি ভেটো ক্ষমতার অধিকারীর অন্যতম রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা আদালতটির কর্তৃত্ব প্রয়োগের এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছে।
এই পরোয়ানা জারির পর অনেকে এখন আশাবাদ প্রকাশ করেছেন, একই অপরাধে অভিযুক্ত মিয়ানমারের সেনাশাসকসহ অন্য অভিযুক্তদের বিচার হবে। আইসিসির প্রতি তাঁরা অচিরেই একই পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। আবার অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আফগানিস্তান, ইরাক ও ফিলিস্তিনে একই ধরনের অপরাধের অভিযোগ আছে যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁদের বেলায় আইসিসি কেন কিছু করেনি?
যে কারণে বিতর্কিত
স্মরণ করা যেতে পারে, জাতিসংঘের একটি তদন্তকারী দল তাদের তদন্ত সম্পন্ন করে গণহত্যার উদ্দেশ্যে জাতিগত নির্মূলের প্রমাণ পাওয়ার কথা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এখন সেসব সাক্ষ্য ও আলামত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের একটি নতুন ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর ২০১৯ সাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। কৌঁসুলি করিম খানও গত বছর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দেখতে গেছেন।
আইসিসি এর আগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আরও দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। দুজনই আফ্রিকার দুটি দেশের সরকারপ্রধান ছিলেন। একজন হলেন সুদানের ওমর আল বাশার এবং অপরজন লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফি।
রোম সনদের আলোচনার সময়েই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোশেভিচের আর আইসিসি প্রতিষ্ঠার পরও ২০১২ সালে আফ্রিকায় একটি বিশেষ আদালত করে বিচার করা হয় লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরের।
কিন্তু তারপর ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের সামরিক জোটের সদস্যদেশগুলোর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো অভিযোগ উঠেছে। ওই সব দেশের নিজস্ব বিচারব্যবস্থায় অনেক সেনাসদস্যের বিচারও হয়েছে। তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ইরাকে অভিযান পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আইসিসি কর্ণপাত করেনি।
ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানাচ্ছে, জঙ্গিসংগঠন আল-কায়েদাকে সাহায্য করছে— এসব অভিযোগ তুলে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী। ‘সন্ত্রাসবাদ দমন’—বিশ্বজুড়ে এই শব্দবন্ধের প্রচল হয় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের যুক্তরাষ্ট্রে সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে। এর জেরেই মূলত ইরাকে হামলা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুসারে, ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ৬ হাজার মানুষ এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা রবার্ট ইনলাকেশের মতে, মার্কিন হামলায় ১০ লাখেরও বেশি ইরাকি নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধে ইরাকে সাধারণ মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে কারাগারে বন্দী নির্যাতনের অহরহ ঘটনা ঘটেছে। ইরাকের আবু গারিব কারাগারের কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেখানে বন্দী নির্যাতনের ঘটনা ছিল বহুল চর্চিত বিষয়। সময়ের ব্যবধানে সেসব ঘটনা চোখের সামনে থেকে সরে গেছে। কিন্তু ইরাকে হামলার জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কী হবে?
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনী ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে এবং তালেবানের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের জন্য আইসিসি সিদ্ধান্ত নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ও হুমকির মুখে তা আর এগোয়নি। ২০২০ সালের ৫ মার্চ আইসিসির প্রাক্-বিচারিক ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত পরিচালনার যৌক্তিক কারণ রয়েছে ঘোষণা করে ওই তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনেই মার্কিন বাহিনীর অপরাধের কথা উঠে এসেছে। সেখানে হত্যা, বিচারবহির্ভূত গ্রেপ্তার, নির্যাতন—হেন কোনো অপরাধ নেই যে পশ্চিমা বাহিনীরা করেনি।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ৬৯ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে আফগান বেসামরিক মানুষ মারা গেছে ৫১ হাজার বেশি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাড়ে তিন হাজারের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন। ২০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এই যুদ্ধে আহত হয়েছেন। কোটির বেশি মানুষ এই যুদ্ধে উদ্বাস্তু হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি দেশ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেটি হলো ইয়েমেন। এই গৃহযুদ্ধে আবার নতুন আরেক শক্তি নজরে আসে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন বাহিনী নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে সেখানে। অবাক করা ব্যাপার হলো, ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী চালিয়েছে। এ হামলা মানবিক বিপর্যয়কে এক চূড়ান্ত মাত্রায় নিয়ে গেছে।
তিন কোটি জনবসতির এই দেশে মারা পড়েছে তিন লাখের বেশি মানুষ। জাতিসংঘের হিসাবে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে। আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, ইয়েমেন যুদ্ধ ও যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কারণে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।
যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ৪৫ শতাংশই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই ‘নিরাপত্তাহীন’ একটি মার্জিত শব্দ আসলে। লক্ষ্য করে থাকবেন, সেখানকার দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশুদের দিকে তাকানো বেশ কষ্টসাধ্য। ইয়েমেনে এমন অনেক শিশুর ছবি পাওয়া যায়, গণমাধ্যমে প্রকাশ করাও কঠিন। গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশ করাও কঠিন এমন অনেক ঘটনা আফগানিস্তান, ইরাকেও ঘটেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমই এমন ঘটনা প্রকাশ করেছে। কিন্তু পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো নয়।
মূলত যেকোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া উচিত। সেই বিবেচনায় রুশ প্রেসিডেন্টকে বিচারের আওতায় আনা অনেক বড় ঘটনা। আবার এমন অপরাধ বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন ওঠে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, যুক্তরাষ্ট্র সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, সৌদি আরব বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ কিংবা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে কী বিচারের আওতায় আনতে দেখা যাবে?
এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রভাব
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষেত্রেও তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে সনদে অংশগ্রহণকারী ১২৩টি দেশে তাঁর সফর যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল, তেমনি ওই সব দেশের জন্যও তা এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল।
আইসিসি যাঁকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করতে চায়, তেমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রাখাও এখন এসব দেশের সরকারগুলোর জন্য কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনে আগ্রাসনের সমর্থকেরা এখন আইসিসির পরোয়ানাকে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার আরেকটি প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় সফল না হওয়ায় আদালতকে এখন হাতিয়ার করা হচ্ছে।
স্পষ্টতই এ বিতর্ক আন্তর্জাতিক আদালতের কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে দিয়েছে। এটি এমন সীমাবদ্ধতা, যা থেকে উত্তরণ না ঘটলে বিশ্বে আগ্রাসন, জাতিগত নিপীড়ন ও গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর ন্যায়বিচার অধরাই থেকে যাবে।
‘জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য ও নীতিগুলোয় যেকোনো রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি বা শক্তির ব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য সব রাষ্ট্রের নিবৃত্ত থাকার’ যে অঙ্গীকার রয়েছে, রোম সনদের প্রস্তাবনায় তা পুনর্ব্যক্ত করার কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তিধর রাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় এবং সাহসী কাজ। কিন্তু নীতিটি সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে না পারার ব্যর্থতার দরুন সৃষ্ট বিতর্ক এড়ানো তো সহজ নয়।
এসডব্লিউএসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ