সৃষ্টির যাবতীয় নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চলেছে বিজ্ঞান। যা ভাবনা চিন্তারও বাইরে, সেই অসম্ভবই সম্ভব হতে চলেছে। এমন এক গবেষণার পথে এগোচ্ছে জাপান যা গোটা পৃথিবীকেই নাড়িয়ে দেবে একটা সময়।
নীতিগতভাবে এই গবেষণা সঠিক না বেঠিক তা বিচার করার সময় এখনও আসেনি, তবে সে গবেষণা পদ্ধতিতে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা, তা চমকে দেওয়ার মতোই।
সম্প্রতি পুরুষ ইঁদুরের কোষ থেকে ডিম্বাণু তৈরি করে ইঁদুরশাবকের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল নেচারে প্রকাশিত গবেষণাটি করেছেন কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয় ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক কাতসুহিকো হায়াশি।
গবেষণাপত্রের পাশাপাশি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির স্টেম সেল ও প্রজননবিশেষজ্ঞ ডায়ানা লেয়ার্ড এবং তাঁর সহকর্মী জোনাথন বায়ের্লের একটি মন্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁদের মতে, গবেষণাটি ‘প্রজনন গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে’।
এ গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতে হুমকির মুখে থাকা স্তন্যপায়ী প্রজাতিগুলোর একক পুরুষ প্রাণী থেকে সন্তান জন্মদান সম্ভব হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন ডায়ানা লেয়ার্ড ও জোনাথন বায়ের্ল।
তাঁরা বলেন, ‘সমকামীদের ক্ষেত্রে অন্যের ডিম্বাণু ব্যবহারের নৈতিক ও আইনি সংকট এড়িয়ে নিজেদের সন্তান জন্মদানের সুযোগও তৈরি করছে এই গবেষণা।’
অধ্যাপক কাতসুহিকো হায়াশি অবশ্য বলছেন, এ গবেষণা এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। গত সপ্তাহে লন্ডনের ক্রিক ইনস্টিটিউটে জিন এডিটিং সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ইঁদুর এবং মানুষের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।’
২০১৮ সালে চীনের একটি গবেষণায় দুই নারী ইঁদুর থেকে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পুরুষ ইঁদুর থেকে সন্তান জন্ম দিতে পারলেও সেগুলোকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
জাপানের বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় একটু ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁদের গবেষণায় পুরুষ ইঁদুর থেকে জন্ম দেওয়া সন্তান স্বাভাবিকভাবে বড় হয়েছে এবং নিজেরাও সন্তান জন্ম দিয়েছে।
বিজ্ঞানের যুগে সবই সম্ভব। এর পেছনে আছে ক্রোমোজোম আর স্টেম কোষের কারসাজি। আর আছে হিউম্যান জিনোম এডিটিং। মানুষের শরীরের মূলতত্ত্বই হল জিন বা ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)। এই জিনের বিন্যাসকে কাটা-ছেঁড়া করে উল্টে-পাল্টে সবই করা সম্ভব। জিন এডিটিং যে কোনও অসাধ্য সাধন করতে পারে যদি তা সঠিকভাবে করা হয়। একদিকে যেমন দুরারোগ্য ব্যধি নির্মূল করতে পারে, অন্যদিকে এমন নানা গবেষণায় চমক ঘটাতে পারে।
সহজ করে বুঝিয়ে বলা যাক। আমাদের দেহ যে ট্রিলিয়ন কোষ নিয়ে তৈরি। তার সূচনা হয় মূলত জাইগোট নামক একটি মাত্র ভ্রূণকোষ থেকে। বাবা-মায়ের থেকে প্রাপ্ত শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনে তৈরি হয় জাইগোট। ধীরে ধীরে এই জাইগোট কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ব্লাস্টোসিস্টে পরিণত হয়। এই ব্লাস্টোসিস্টের ভেতরে থাকে একধরনের স্টেম কোষ।
মূলত এই স্টেম কোষকেই বলা হয় শরীরের অন্যতম আধার। স্টেম কোষ থেকেই পরবর্তীতে দেহের যে কোনও কোষ তৈরি হতে পারে। একসময় ব্লাস্টোসিস্ট এক্টোডার্ম, মেসোডার্ম, এন্ডোডার্ম নামে তিন স্তরে ভাগ হয়ে ত্বক, পেশি-কলা, কঙ্কালতন্ত্র, পৌষ্টিকতন্ত্র সহ পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের নানা অংশ তৈরি করে।
পূর্ণাঙ্গ মানব শরীরের নানা অঙ্গে থাকে নানা ধরনের স্টেম কোষ। যেমন মস্তিষ্কে নিউরাল স্টেম কোষ, অস্থিতে হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষ। প্রত্যেকের কাজ আলাদা। হেমাটোপয়েটিক স্টেম কোষগুলো দেহের যাবতীয় রক্তকণিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে, নিউরাল স্টেম কোষ দেহের উদ্দীপনা, কোষে কোষে বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম নিউরন তৈরি করে। এইভাবে স্টেম কোষ নানাভাগে ভাগ হয়ে শরীরের নানা অঙ্গ ও তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে।
ত্বকের কোষেও থাকে স্টেম সেল। এই স্টেম কোষ কৃত্রিমভাবে তৈরির এক অনন্য পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে আগেই। কৃত্রিম এই স্টেম কোষের নাম প্লুরিপোটেন্ট স্টেম কোষ। শিনইয়া ইয়ামানাকা নামে এক বিজ্ঞানী এই পরিবর্তিত স্টেম কোষ তৈরি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। জাপানের কিউশু ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এই প্লুরিপোটেন্ট স্টেম কোষ নিয়েই কাজ করেছেন।
এবার জানা যাক কীভাবে প্লুরিপোটেন্ট স্টেম কোষ নিয়ে কাজ করলেন বিজ্ঞানীরা। এক্স (X) আর ওয়াই (Y) ক্রোমোজোমের ব্যাপারটা সকলেরই কমবেশি জানা।
‘এক্স’ ও ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম দিয়ে গঠিত হয় পুরুষ শরীর (XY) আর নারী শরীরে থাকে দুটোই এক্স’ (XX) ক্রোমোজোম। তাই নারী-পুরুষের মিলনের সময় সন্তানের ভ্রূণে বাবার থেকে ‘ওয়াই’ (Y) ও মায়ের থেকে ‘এক্স’ (X) ক্রোমোজোম নিয়ে ‘এক্স-ওয়াই’ (XY), অথবা দুজনের থেকেই ‘এক্স’ (X) ক্রোমোজোম নিয়ে ‘এক্স-এক্স’ (XX) তৈরি হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়। এই এক্স ক্রোমোজোমকে বিশেষ উপায় ডুপ্লিকেট করে সংখ্যাতেও বাড়িয়েছেন। তারপর নিষেক ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে অন্য ইঁদুরের গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছেন।
সন্তানের জন্ম হবে সারোগেসিতে মানে অন্য গর্ভে, কিন্তু সন্তান হবে দুই পুরুষের শরীরজাতই। তার মধ্যে দুই বাবারই কোষ ও জিন থাকবে। দুই বাবার বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্মাবে সে। বিজ্ঞানীরা এইভাবে ৬টি ইঁদুর ছানা তৈরি করেছেন।
তবে গবেষণাটি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। গবেষণায় ৬৩০টি ভ্রূণ নারী ইঁদুরের গর্ভে স্থাপন করা হলেও কেবল সাতটি থেকেই সন্তান জন্ম দেওয়া গেছে।
কেন এত অল্পসংখ্যক ভ্রূণ বাঁচল, সেটি এখনো গবেষকেরা নিশ্চিত হতে পারেননি। মানুষের স্টেম সেলে কীভাবে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, সেটিও নিশ্চিত নন তাঁরা।
জিনের পরিবর্তন ঘটানোর প্রক্রিয়ায় ভুল বা অন্য কোনো কারণে যেসব জটিলতা তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সতর্ক থাকার ওপর জোর দিয়েছেন ডায়ানা লেয়ার্ড।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ