পৃথিবীতে যে পানি দেখা যাচ্ছে তা তৈরি হয়েছিল সূর্য তৈরির আগেই। কিন্তু সূর্য তৈরির পরই তো পৃথিবী এল। আবার পৃথিবীর পানি তার আগেই তৈরি হয়েছিল। সেই বিপুল জলরাশিই এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
আগে ধারণা করা হতো পৃথিবীতে যে পানি আছে তা গঠিত হয়েছে সূর্যের গঠনের সময়ই। তবে কিছু বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেছেন যে, পৃথিবীর বুকে কিছু পরিমাণ পানি সূর্যের গঠনের আগেই তৈরি হয়েছিল। সহজ ভাষায় বললে পৃথিবীতে পানির বয়স সূর্যের চেয়েও বেশি। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন সূর্যের আগেই পৃথিবীর পানি তৈরি হল কীভাবে? কারণ পৃথিবীটাই তো ছিলনা! তাহলে তার পানি এল কোথা থেকে? এর উত্তরও দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেটা কীভাবে সম্ভব হল তা তারা পরিস্কার করেছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সূর্যের গঠনের সঙ্গে সঙ্গে এ সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ, গ্রহাণুসহ সব উপাদান গঠন হওয়া শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে গঠিত হওয়া শুরু হয় পৃথিবী। সে সময়ে মহাবিশ্বে সূর্যের আশপাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকা বস্তু মিলে গঠিত হয় পৃথিবী এবং এর সব উপাদান। মাটি, পানি থেকে শুরু করে সবকিছু। তবে সেই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এখন যে পানি পান করা হচ্ছে, প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগছে তা তৈরি হয়েছিল সূর্যেরও জন্মের আগে। আতাকামা লার্জ মিলিমিটার অ্যারে টেলিস্কোপ কাজে লাগিয়ে এই নতুন এক তত্ত্ব সামনে এনেছেন বিজ্ঞানীরা।
ইউরোপীয়ান সাউথ অবজারভেটরির (ইএসও) একদল গবেষক বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির আতাকামা মরুভূমিতে স্থাপিত আতাকামা লার্জ মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে (এএলএমএ) থেকে একটি গ্রহ পর্যবেক্ষণ করছেন। যেটি ভি৮৮৩ ওরিয়ন নামে একটি প্রটোস্টার বা অগঠিত তারাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তারা দেখতে পেয়েছেন, সেই তারকাটিকে কেন্দ্র করে একটি পানির চাকতি গঠিত হয়েছে।
প্রটোস্টার হলো এমন এক ধরণের তারকা যা বড় কোনো তারকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তার ধ্বংসাবশেষ থেকে গঠিত হয়। কিন্তু তারকাটির কেন্দ্র সুগঠিত না হওয়ায় সেখানে প্রয়োজনীয় ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয় না। ফলে পর্যাপ্ত তাপও উৎপাদিত হয় না। তারকাটির কেন্দ্র ক্রমে ক্রমে সুগঠিত হতে থাকে। ফলে যতই সময় যায়, তারকাটি সুগঠিত হতে থাকে এবং এর আশপাশের বস্তু মিলে সেটিকে কেন্দ্র করে ঘোরার মতো গ্রহ ও উপগ্রহ গঠন করে। সে সময়টিতে সেই প্রটোস্টারটিকে কেন্দ্র করে পানির কণার এটি বলয় গঠিত হয়।
গবেষকরা এই বলয়ে পানির উপাদানের রাসায়নিক গঠন পরিমাপ করে দেখছেন। যা আমাদের ধারণা দেয়, কোথায় এবং কখন এই পানির কণাগুলো গঠিত হয়েছিল।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি ধূমকেতুতে পাওয়া পানির রাসায়নিক গঠন যদি পৃথিবীর মতোই হয় তবে এটি বলা যেতেই পারে যে, সেই ধূমকেতুটি আমাদের গ্রহে সুদূর অতীতে সম্ভবত পানির যোগান দিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, একটি নক্ষত্র তৈরি হওয়ার দিকে নজর দিতে বিষয়টি তাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে। তারা জানাচ্ছেন ওই টেলিস্কোপের সাহায্যে তারা ১ হাজার ৩০০ আলোকবর্ষ দূরে একটি নক্ষত্র জন্ম নেওয়ার পর তার চারধারে যে বলয় তৈরি হয়েছিল তার দিকে নজর দিতে সেখানে তারা গ্যাসের আকারে পানির সন্ধান পান।
নক্ষত্র তৈরির আগে সেখানে এক বিশাল গ্যাস ও ধুলোর স্তম্ভ সৃষ্টি হয়। তারপর ক্রমে তা থিতিয়ে পড়তে থাকে। তার কেন্দ্রে জন্ম নেয় নক্ষত্র। আর সেই নক্ষত্রের চারধারে একটি বলয় সৃষ্টি হয়। যা থেকে গ্রহ, ধূমকেতু, গ্রহাণু তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, নক্ষত্র সৃষ্টির যে গ্যাসের মেঘপুঞ্জ তৈরি হয় সেখানেই লুকিয়ে থাকে পানি। তবে পানি এমন এক বরফের মত আকারে থাকে যে তা সহজে নজরে পড়েনা। এই নক্ষত্র সৃষ্টির মেঘ থেকেই জল এসে পৌঁছয় গ্রহে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন এই যে নক্ষত্র তৈরির পর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ক্রমে তার বলয়ে গ্রহ, ধূমকেতু, গ্রহাণু সৃষ্টি হয়, তেমনই কোনও ধূমকেতুর হাত ধরে গ্রহে সেই মেঘপুঞ্জের পানি এসে পৌঁছে যায়। যা থেকে গ্রহে পানি তৈরি হয়।
তাই নক্ষত্র সৃষ্টির আগেই সেখানে জলের অস্তিত্বের জন্ম দিচ্ছে এই নক্ষত্র সৃষ্টিকারী গ্যাসীয় মেঘপুঞ্জ। যা থেকে বিজ্ঞানীদের ধারনা নক্ষত্রে সৃষ্টির আগেই পানি এসে পড়ে। সূর্যের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল বলে মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরির গবেষক জন জে টবিন বলেছেন, ‘ভি৮৮৩ ওরিয়ন এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি সংযোগ স্থাপনকারী বিষয় হতে পারে। যা আগে অনুপস্থিত ছিল। এর আশপাশের বলয়ের পানির কণার গঠন আমাদের সৌরজগতের ধূমকেতুতে থাকা পানির কণার মতোই।’
জে টবিন আরও বলেন, ‘এর মানে হলো, এ বিষয়টি এ ধারণার নিশ্চিত করছে যে, সূর্য গঠনের কয়েক বিলিয়ন বছর আগেই আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে তৈরি পানি তৈরি হয়েছিল। সৌরজগতে ধূমকেতু এবং পৃথিবী উভয়ই পানি সেখান থেকেই পেয়েছে।’
এসডব্লিউএসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ