বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষার হার এখন ৭৩ শতাংশ। স্বাধীনতার সময় যেখানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৪ শতাংশ ছিল, তা এখন বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর পেছনে বাংলাদেশের ক্রমশ এগিয়ে চলা গার্মেন্টস খাত সব থেকে বড় ভূমিকা রাখছে।
কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগের এক দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৭ শতাংশ। শুধুমাত্র চীনের থেকেই পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ, যদিও ব্যবধান ছিল একেবারেই সামান্য।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২৫০০ ডলার, যা ভারতের থেকে বেশি। ২০২৬ সালেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ হবে বাংলাদেশের। এরপর ২০৩১ সালের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হতে চায় বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের এই উন্নয়নের গতিপথ এখন পরীক্ষার মুখে। কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
আগামী বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে আয়োজিত হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। এর ফলাফল কী হবে তা নিয়ে বড় কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান সরকার বিরোধীদের দুর্বল করতে যা যা করা সম্ভব করেছে। তারপরেও অনেকেই মনে করছেন, রাজনীতিতে ‘জিরো-সাম’ কৌশল নির্বাচনকালীন সময়ে ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দেবে। চাপে থাকলেও এখনো টিকে থাকা বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)এর নেতারা রাজপথে সক্রিয় আছেন।
এদিকে ঢাকার দুর্নীতির গন্ধ শহরটির দূষিত বাতাসকেও হার মানিয়েছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলা বাংলাদেশ যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। যদিও ঢাকা ও এর বাইরে থাকা শপিংমল-কারখানাগুলোতে এখনো বাংলাদেশিদের সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। এই সক্রিয়তাই বাংলাদেশের অপ্রত্যাশিত সফলতার মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের বহু মানুষ বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন, দেশকে নতুন করে গড়তে সহায়তা করেছিলেন।
এরকমই একজন মানুষ দাতব্য সংস্থা ব্রাক চালু করেন। এই সংস্থা নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করেছে। দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করতে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু করেছে। এনজিওগুলি লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতের জন্য অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে।
ফলে বড় পর্যায়ে দেশের সামাজিক, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানসহ কিছু উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এখনো এনজিওগুলিকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখে। সেখানে বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে আরও কাছে টেনে নিয়েছে। ব্রাক এখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে নিজেদের পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার দুই-পঞ্চমাংশ এখনো কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে বিশ্বব্যাংক এবং অন্য সংস্থাগুলো যেভাবে সড়ক ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে তাতে গ্রামগুলো এখন শহরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে স্থানীয় কৃষি লাভবান হচ্ছে। ঢাকার আশেপাশে বিশ্বমানের পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে। সরকার শুল্ক ও সেকেলে শ্রম আইন বাতিল করে এ উন্নয়নে আরও গতি বৃদ্ধি করেছে।
২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। বহুদিন ধরেই বিদ্যুৎ একটি বড় সমস্যা ছিল। পাশাপাশি রাজধানীতে যানজট ও বায়ু দূষণের চোখ রাঙানিতে মানুষ জর্জড়িত। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় যোগাযোগ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গত বছর পদ্মা নদীর উপর নির্মিত বিশাল সেতু চালুর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে গেছে।
ঢাকায় এখন নতুন বিমানবন্দর টার্মিনালসহ একটি এলিভেটেড মেট্রো তৈরি হচ্ছে, যে প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে জাপান। দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটি স্বল্পমেয়াদে যানজট তৈরি করছে বটে তবে এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
এত এত দৃশ্যমান অগ্রগতি সত্ত্বেও বিদেশি কূটনীতিক, নিরপেক্ষ বিশ্লেষক এবং এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্যজ্জনেরাও গোপনে অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
‘ব্যালেন্স-অব-পেমেন্টস’ নিয়ে সংকট রয়েছে। আরেকটি সংকট হলো পোশাক শিল্পের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা। শাসনকার্যের জন্য এগুলো বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবক্ষয়ের নীতি জাল বিস্তার করেছে।
এই দুর্বলতার কারণে পরিচিত কিছু দুর্ভোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এরমধ্যে আছে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। সময় থাকতে গত বছর আইএমএফ’র দ্বারস্থ হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয় সংস্থাটি।
তবুও টাকা এখনো দুর্বল। সরকার এখন আমদানিতে লাগাম টানার চেষ্টা করছে। কিন্তু এর জেরে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি করতে পারছেন না রপ্তানিকারকরা। এলসি খুলতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এগুলো ছাড়া চাইলেই তারা ব্যবসা করতে পারছেন না।
এদিকে দেশের পোশাক শিল্প আরও দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ঢাকার একটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, পোশাক শিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আদপে একটি ‘গুরুতর দুর্বলতা’।
এই খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। স্বল্পোন্নত দেশের স্ট্যাটাসে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা বাজারে শুল্ক ছাড়ের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। কম খরচে উৎপাদন করতে পারায় বাংলাদেশ একসময় চীনের বাজার ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন কম্বোডিয়া ও ইথিওপিয়া বাংলাদেশের বাজার ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি সৃষ্টি করছে।
অন্যান্য রপ্তানি শিল্পও প্রবৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশ কোনো বড় আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটের সদস্য নয়। চীন থেকে অন্যত্র সরে যাওয়া ব্যবসাগুলোর কিছু অংশ নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইলেকট্রনিক্স শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে আমলাতন্ত্র এবং অসম কাস্টম শুল্ক তাদের পথ আগলে রেখেছে। একটি দেশে ব্যবসার পরিবেশ কেমন তা নির্ধারণে একটি তালিকা তৈরি করেছে দ্য ইকোনমিস্ট-এর একটি সহকারী কোম্পানি দ্য ইইউ। এতে এশিয়ার ১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।
এটি দেশের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। এর শোচনীয় শাসন ব্যবস্থা দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করে, এমনকি বিদেশি বিষয়গুলোতেও। বাংলাদেশের ধনী ও দুর্নীতিবাজরা দেশটিকে টাকা পাচারে বিশ্বে প্রথমদিকে নিয়ে এসেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কানাডার টরন্টোসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি বসবাসকারী এলাকাকে ‘বেগম পাড়া’ বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে।
যদি মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যত্র কর্মরত দরিদ্র বাংলাদেশিরা যদি দেশে রেমিট্যান্স না পাঠাতো তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও বড় সংকটে পড়তো।
ব্যবসা আর রাজনীতি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ঋণ খেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর জন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতাধরদের ঋণ প্রদানে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়া। কিন্তু এই ব্যক্তিরা ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেন না।
সরকারি কোনো চুক্তি জেতা থেকে শুরু করে কোস্টগার্ডের চাকরি কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্যও চলছে টাকার খেলা। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর কর্মীদের যেভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না। উল্টো তাদেরকে ইমিগ্রেশনে হেনস্তার শিকার হতে হয়।
যদিও সকারের দাবি, দুর্নীতি দমন করা হয়েছে। আসলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।
ভিন্নমতাবলম্বীদের স্থান হয়েছে কারাগারে, কয়েকজনকে হত্যাও করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও নিজেদের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছে আওয়ামী লীগ। একটি ডর্ম রুম পেতে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নেতাদের কাছে যেতে হয়। মেধাবী বাংলাদেশিরা এখন বিদেশে চলে যেতে আকুল হয়ে আছে।
সামনে ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন। নির্বাচনী ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক আগেই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথা বাতিল করা হয়েছে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনার চির প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখা এবং বিরোধী দল বিএনপিকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টাই বলে দেয় নির্বাচনের ফল কোন দিকে যাবে। তবে বিএনপি সম্প্রতি ঢাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ আয়োজনে সফল হচ্ছে।
এতে করে সামনের দিনগুলোতে সহিংস দাঙ্গা এবং রাজনৈতিক বিভাজন আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এটি হচ্ছে উদ্বেগজনক একাধিক দৃশ্যকল্পের একটি। শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৫ এবং তিনি এখনো তার কোনো উত্তরসূরি নির্বাচিত করেননি। পরিবারের তুলনামূলক কম বয়সীদের দায়িত্ব নেয়ার অভিজ্ঞতা ও ইচ্ছার অভাব রয়েছে। নতুন কোনো পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এসডব্লিউএসএস/০৮৫৪
আপনার মতামত জানানঃ